সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারানোর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাহত সুধীজনদের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছে বাংলানিউজ।
স্বপ্ন পূরণের আগেই চলে গেলেন : সৈয়দ শামসুল হক
তারেক মাসুদের এই হঠাৎ চলে যাওয়া সত্যিই মেনে নেয়ার মতো নয়। পরশু রাতেই তার সাথে আমার শেষ কথা হলো। শেষ দিকে এসে তারেক আমাকে একটি কথাই বলতেন যে এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কিছু করার জন্য। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীরা কি করেছে তার সারমর্ম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সবার মাঝে তুলে দেবার প্রচন্ডরকম ইচ্ছে ছিলো তার। সে অনুযায়ী সম্ভবত তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই চলে গেলেন তারেক মাসুদ। সত্যিই এই চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারছিনা।
দেশকে দেওয়ার আরো ক্ষমতা ছিল : চাষী নজরুল ইসলাম
দুজন মেধাবী মানুষ আমাদের ছেড়ে গেলেন, তাদের এই চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না। তাদের দেশকে দেওয়ার আরো ক্ষমতা ছিল। দূর্ভাগ্য আমরা তা থেকে বঞ্চিত হলাম। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা যে কতটা ভদ্র হতে পারে, সেটা আমরা তারেক মাসুদকে দেখে বুঝেছি। তারেক যে কাজ করতেন, সেটি জেনে ও বুঝে করতেন। তার যে চিন্তাধারা ছিল, সেটি অসাধারণ। আমাদের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়েই তারেক মাসুদ কাজ করতেন।
সবার থেকেই তার ভাবনা ছিল একেবারেই ভিন্ন : নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু
তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার পরিচয় তার প্রথম তথ্যচিত্রের ছবি ‘আদম সুরত’ নির্মাণের সময়ই। অর্থাৎ তখন থেকেই আমি তাকে চিনি এবং তার সম্পর্কে জানি। আমি নব্বই দশকের শুরু থেকেই ওর মাঝে চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবনা দেখেছি। সবার থেকেই তার এই ভাবনা যেন একেবারেই ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারেক মাসুদ একাধিক ছবি নির্মাণ করেছেন। তার ‘মুক্তির গান’ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংগীতশিল্পীরাসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা কিভাবে দেশমাতৃকা রক্ষার জন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারেক মাসুদ তার ছবিতে সেটিই তুলে ধরেছিলেন। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যেই কাজ করার কথা ছিল- তারেক মাসুদ সেই কাজই করেছে। আমি ওর কাজে কৃতজ্ঞ, ওর কাজে সন্তুষ্ট। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
এই শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয় : তানভীর মোকাম্মেল
এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চলে যাওয়াটা এরকম নির্মম হবে, তা মেনে নিতে পারছি না। তারেক ছিল আমার ৩০ বছরের সহযোদ্ধা। তার ছবি `মুক্তির গান` থেকে শুরু করে `মাটির ময়না`, `অন্তর্যাত্রা` আর সর্বশেষ `রানওয়ে`সহ সব ছবি দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। এই মেধাবী নির্মাতাকে হারানোর শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। এ রকম নির্মাতা চট করে জন্মায় না। অনেক ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের ফল তারেক মাসুদ।
চলচ্চিত্রের দিক পরিবর্তনের বড় মাপের সংগঠক ছিলেন: সারা যাকের
তারেক মাসুদ আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের দিক পরিবর্তনের একজন বড় মাপের সংগঠক ছিলেন। তার প্রতিটি চলচ্চিত্রে আমরা সমাজ পরিবর্তনের কিছু বিষয় পেতাম, যা সত্যিই সমাজ বদলের জন্য মানুষের মধ্যে ভাবনা জাগাতো। এক্ষেত্রে মাটির ময়না কিংবা রানওয়ে ছবির কথা আমরা বলতে পারি। তারেকের আরেকটি বিষয় আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। সেটা হলো তারেক তার নির্মিত ছবি কখনোই চ্যানেলে প্রদর্শন করতে দিতেন না। ছবির প্রচারের জন্য তিনি নিজে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতেন এবং সেইসব ছবি দেখার ব্যাপারে সবাইকে খুব উৎসাহ দিতেন। সর্বশেষ তার রানওয়ে ছবিটি নিয়ে তিনি দেশের বিভাগীয় শহরগুলোসহ আরো অনেক স্থানে গিয়েছেন। নিজের ছবির প্রচারণা তিনি নিজেই করতেন। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের এই অকাল প্রয়াণ আমাদের দেশের দুর্বল সড়ক ব্যবস্থারই আবার জানান দিলো।
ইভটিজিংয়ের মতো সড়ক দুর্ঘটনাও একধরণের দুর্যোগ : ইলিয়াস কাঞ্চন
প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের নানা অঞ্চলে মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিন্তু এদিকে সরকারের কোনই দৃষ্টি নেই। দেশে প্রতিদিনই মানুষ যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি গাড়িও বাড়ছে। সেই সাথে চালকের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু যথাযথভাবে গাড়ি চালানো শিখে অনেকেই গাড়ি চালাচ্ছেন না। আর একারণেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। ঠিক তেমনি একটি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বরেণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। আমি একা সত্যিই আর পারছিনা। ইভটিজিং-এর মতো সরকারকে সড়ক দুর্ঘটনাকে একধরণের দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত করে এটা খুব দ্রুত প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে শুধু তারেক মাসুদই নয় একে আমরা সবাই এমনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবো। সরকারের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ সড়ক দুর্ঘটনাকে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যদিয়ে চালকদেরকে আরো অধিক সচেতন করার মধ্যদিয়ে এটি রোধ করতে হবে। আমি তারেক মাসুদ-এর বিদেহী আত্বার মাগফেরাত কামনা করছি।
ছবিকে মনে করতেন নিজের সন্তান : আবু সাইয়ীদ
তারেক মাসুদ কখনোই নিজের ছবিকে বিকল্প ধারার কোন ছবি মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন তার প্রতিটি ছবিই মূলধারার। অসম্ভব যত্ন নিয়ে করতেন তিনি ছবির কাজ। ছবিকে মনে করতেন নিজের সন্তান। আর তাই তারেক মাসুদের সবগুলো ছবিই দর্শক নন্দিত হয়েছে। খুব গুণী একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা আমরা হারালাম। তবে সরকারের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ যেন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন। যদ তা করতে পারেন তাহলে হয়তো এভাবে অশালে আমাদেরকে আমাদেও প্রিয় প্রিয় মানুষকে হারাতে হবেনা।
মূলধারার বানিজ্যিক ছবিকে খাটো করে দেখেন নি : মহম্মদ হান্নান
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে তারেক মাসুদেও বিদেহী আত্বার মাগফেরাত কামনা করছি। তার এই অকাল মৃত্যুকে আমরা কেউই মেনে নিতে পারছি না। এই গুনী চলচ্চিত্রকার যদিও মূলধারার বানিজ্যিক ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে কখনোই তিনি কাজকে খাটো দেখেন নি। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের জনপ্রিয় নায়ক ইরয়াস কাঞ্চন একাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। আমার কথা হচ্ছে শুধু ইলিয়াস কাঞ্চন একা কেন, তার সাথে সরকারসহ সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা মারা গেছেন বিধায় যে তিনি এই আন্দোলনে জড়িয়ে আছেন তাই নয় সত্যিকার অর্থেই তিনি চাচ্ছেন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। যদি আরো ানেক আগেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া যেতো তাহলে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে হারাতে হতো না।
অন্যেকেও স্বপ্ন দেখাতে জানতেন : জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়
তারেক মাসুদ নিজে স্বপ্ন দেখতেন, অন্যেকেও স্বপ্ন দেখাতে জানতেন। স্বপ্ন নিয়েই নিয়েই তিনি কাজ করতেন। এমন একজন স্বপ্নবাজ মানুষের এভাবে দুঃস্বপ্নের মতো চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। গাড়ি চড়ার ক্ষেত্রে খুব সচেতন ছিলেন তারেক মাসুদ। তার ওপর কিভাবে এ দুর্ঘটনা নেমে আসে? এইদেশে জীবন হাতে নিয়ে চলি আমরা। এখানে জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি কার কাছে জানতে চাইবো, কেন আমাদের তারেক মাসুদকে হারাতে হলো?
আমাদের মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন : কেরামত মওলা
তারেক মাসুদের কোন ছবিতেই আমার অভিনয় করা হয়ে উঠেনি। কথা ছিল তার ছবিতে অভিনয় করার। কিন্তু সেই কথা আর পূরণ করা হবেনা। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তারেক। খুব খুব মেধাবী একজন নির্মাতাকে আমরা হারারাম। সেই সাথে খুব মেধাবী একজন চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরকেও আমরা হরালাম। দুজনই নিজ নিজ গুণে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সপ্রতিভ ছিলেন। তারেক মাসুদ তার মুক্তির গান-এর জন্য আমাদের মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
প্রতিটি মুহূর্ত চোখের সামনে ভেসে উঠছে : রোকেয়া প্রাচী
তারেক ভাই আমাদের সবার জন্য যা করে গেলেন তার ঋণ সত্যিই আমরা শোধ করতে পারবোনা। তারেক ভাইয়ের সাথের প্রতিটি মুহূর্ত আজ চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। একজন পরিপূর্ণ মানুষকে আমরা হারালাম। পনেরো বিশ দিন আগে তিনি দেশের বাইওে গিয়েছিলেন। সেই সময়েই তার সাথে আমার মেষ কথা হয়। বলেছিলেন দেশে ফেরার পর ‘কাগজের ফুল’ ছবিটি নিয়ে আমার সাথে কথা বলবেন। দেশে তারেক ভাই ফিরেওছিলেন। কিন্তু তখন আর কথা হয়নি। হয়তো ভেবেছিলেন ছবিটির শুটিং শুরুও আগে আমার সাথে কথা বরবেন। কিন্তু শেষ দেখা শেষ কথা আর হলোনা তার সাথে। আমাদের সবারই খুব ক্ষতি হয়ে গেলো এমন চমৎকার একজন মানুষকে হারিয়ে। চলচ্চিত্রাঙ্গণে তার অবদান বাংলাদেশের সবাই বহুকাল মনে রাখবে। সেই সাথে তার সাথে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই-ই তাকে আমৃত্যু মনে রাখবে। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
বাংলাদেশ সময় ১৭৫০, আগস্ট ১৩, ২০১১