আজ লিখছি আমার বন্ধু প্রতিম আবদুস সাত্তার খান বাবুর দুঃসাহসিক পরিকল্পনার কথা। দুঃসাহসিক বলছি কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন সুচিন্তা করার মানুষের এখনো অভাব হয়নি কিন্তু অভাব হয়েছে সেই সুচিন্তা এবং চেতনা বাস্তবায়ন করার মতো সৎ এবং যোগ্য মানুষের।
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন যেভাবে শুরু: (লেখক আবদুস সাত্তার খান বাবু)
টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০০৬ সালে ৭ জন মিলে শুরু করি অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের কার্যক্রম। পরে যোগ দেন আরো অনেকে। এরই মাঝে বর্ষা মৌসুমে শুরু হয় যমুনার ভাঙ্গন। ঘর বাড়ি ভেঙ্গে অনেক মানুষ যেমন হয় সহায় সম্বলহীন তেমনি অনেক কৃষকের আবাদি জমিও যায় পানির তলায়। তাদের জন্যে কিছু একটা করতে মন চাচ্ছিল আমাদের। ঢাকার একটা ভ্রমণ দলের (বিটিইএফ) সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তারা কিছু করতে চায় এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য। আমাদের এলাকা বন্যা কবলিত বিধায় তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। প্রথমে তারা চিড়া, গুড়মুড়ি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতে চায়। আমরা তাদের বলি আপনাদের উদ্যোগটা মহতী এতে কোনো সন্দেহ নাই।
কিন্তু আমাদের এলাকার এ ধরণের সাহায্য মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। তার চেয়ে যদি বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনে সহায়তা করেন তাহলে গ্রামের মানুষের অনেক উপকারে আসবে। তারা এতে রাজি হন। পরে আমি আমার নিকট আত্মীয় দুইজনের সাহায্য চাই। তাদের বলি একটা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করে দিতে। তারা একটা তালিকা করে । এতে বেশির ভাগ ছিল একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নাম। যেটা আমারা আশা করিনি। পরে পাঠাগারের সদস্যরা রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের তালিকা করে। এখানে একটা অভিজ্ঞতা হয়, তরুণরা অপেক্ষাকৃত নির্মোহভাবে কাজ করতে পারে। টাকার পরিমাণ ছিল পঞ্চান্ন হাজার। আমার মত ছিল প্রতি পরিবারকে ১০০০ করে টাকা দিতে। কিন্তু তালিকায় অনেকের নাম থাকায় আমরা সমস্যায় পড়ে যাই।
পরে এক সদস্য গবেষনা করে বের করেন আমরা যদি ৫০০ টাকা করে দিই তাহলে ১১০টি পরিবারকে আমরা সহযোগিতা করতে পারবো এবং এ টাকা তাদের কাজেও আসবে। যেমন তখন বাজারদর অনুযায়ী ৩০০ টাকায় ৫ কেজি জালা (ধানের চারা গাছের স্থানীয় নাম) পাওয়া যেত। যা থেকে ৮/১০ মণ ধান পাওয়া যাবে। ৪ সদস্যের একটি পরিবার যা দিয়ে অনায়াসে ১ মাস চালিয়ে নিতে পারবে। বাকি ২০০ টাকা সার ও জমি পরিচর্যার কাজে লাগবে।
আমাদের কঠিন শর্ত ছিল এ টাকা দিয়ে অবশ্যই কৃষি কাজ করতে হবে। পাঠাগারের সদস্যরা এ ব্যাপারে নজরও রাখে। প্রায় ৮০ভাগ লোক এ টাকার সঠিক ব্যবহার করেন আর বাকি ২০ ভাগ লোক আর্থিক অনটনের কারণে ঐ টাকা অন্য খাতে খরচ করে ফেলেন। ফসল উঠার পরে তারা নিজেরাই বলেছিল, তারা গড়ে ১০ মণ করে ধান পেয়েছিল। আর ঐ ধান থেকে যে খড় হয়েছিল তার মূল্যই হবে প্রায় ৫০০ টাকা।
২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ অঞ্চলে। পাঠাগারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। সদস্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৩০০ টাকা ও ৫ মণ চাল উঠায়। কিন্তু বিপদ হয় এগুলো আমারা পাঠাবো কি ভাবে। পরে উপজেলা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দিই। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগে এগুলো যথাসময়ে যথাযথ লোকের কাছে পৌঁছবে কিনা?
তখন আমাদের মাথায় আসে যদি ঐ এলাকায় আমাদের পাঠাগারের মতো একটা সংগঠন থাকতো আর তাদের সাথে যদি আমাদের যোগাযোগ থাকতো তাহলে এই সামান্য কটা জিনিসই এই বিপদের দিনে কত না কাজে আসতো। আমাদের এই ভাবনা শেয়ার করি ঢাকার র্যামন পাবলিকেশনের রাজন ভাইয়ের সাথে। ওনি আমাদেরকে আশ্বাস দেন। বলেন যত বই লাগবে নিয়ে যাবেন লজ্জা করবেন না। পরে আমরা লেগে যাই নানা জায়গায় পাঠাগার দেয়ার কাজে।
কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নাটোর, বদলগাছি, মধুপুর, সখিপুর, ভূঞাপুরসহ নানা জায়গায় আমাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে থাকে পাঠাগার। বিছিন্নভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। খাগড়াছড়ির অরং পাঠাগার এ রকম একটি পাঠাগার। আমরা যুথবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নাম নিই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।
পাঠাগারগুলো গড়ে ওঠে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে। এলাকার প্রয়োজন, চাহিদা, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে স্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নেন কী হবে তাদের কর্ম পরিকল্পনা। কেমন হবে তাদের কার্যপদ্ধতি। যেমন জেলা ও থানা পর্যায়ে সাধারণ পাঠাগার থাকায় সেখানে পাঠাগারগুলো হয় বিশেষ ধরনের পাঠাগার। এরকমই একটি পাঠাগার হলো লাইসিয়াম গণিত ও বিজ্ঞান সংঘ। যেখানে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানের নানা সেমিনার, কর্মশালা, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞানমেলা এমনই নানা ধরনের আয়োজন।
সমস্যা যেমন সমাধানও তেমন:
বাংলাদেশ সমতল ভূমির দেশ হলেও সর্বত্র এর ভূমিচিত্র এক নয়। ফলে দেশের এক অঞ্চলের সমস্যা বা সম্ভাবনার সাথে অন্য অঞ্চলের সমস্যা বা সম্ভাবনার রয়েছে বিস্তর তফাৎ। যেমন যমুনার বিস্তীর্ণ চর এলাকার মানুষের যে জীবনযাত্রা, তারা প্রতিনিয়ত যে ধরনের সমস্যা বা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় এবং এর থেকে উত্তরণে তাদের যে অভিজ্ঞতা তার সাথে কোনো মিল নেই বরেন্দ্র এলাকার মানুষের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার সাথে বা তা থেকে উত্তরণ কৌশলের। তেমনি সমুদ্র উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের সাথে হাওর বা পাহাড়ি এলাকার মানুষেরও সমস্যা বা সম্ভাবনাগুলোও এক নয়। অঞ্চলভেদে দেশের সমস্যাগুলো যেমন ভিন্ন ভিন্ন তেমনি তা থেকে উত্তরণের কৌশলও হতে হবে ভিন্ন ভিন্ন। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশের ভূমিপুত্ররা যেভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কৌশল উদ্ভাবন করেছে তার সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে আগামীর উন্নয়ন চিন্তাকে। কিন্তু কোনো ক্রমেই চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ অনুপ্রবেশকারী যতটুকু শৃঙ্খলা আনে তারচেয়ে বিশৃঙ্খলতাই তৈরি করে বেশি।
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের ঘোষণা:
আমরা আমাদের অবস্থান দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন কোনো ক্রমেই পাঠক তৈরির আন্দোলন নয়। যদি পাঠক তৈরি হয়ই সেটি তার বাড়তি পাওনা। এর আসল কাজ হলো প্রথমে গ্রামের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। তারপর সকলকে নিয়ে স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে সবচেয়ে সস্তায়, সহজ বিকল্প উপায়ে অতিদ্রুত তার সমাধান করা। কোনোভাবেই সরকার বা অন্য কোনো সংগঠনের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। যেমন দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে মাঝে মাঝে বাঁধ ভেঙ্গে লোনা পানি আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ে। এতে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যদি দ্রুত বাঁধ মেরামত করা না হয় তবে প্রতিদিন জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এবং জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেয়। ফলে জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। কিন্তু এ সময়ই যদি একদল উদ্যোগী মানুষ একত্রিত হয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে তা অতি সহজে স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প শ্রমেই দ্রুত মেরামত করা সম্ভব। যা আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন আকারে দেখতে পাই। এখন আমরা ঐ স্বল্প অথচ সংঘবদ্ধ মানুষগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টাকেই আমরা নাম দিতে চাই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’। কারণ ঐ মানুষগুলোর কাছে পুরো গ্রামটাই একটা পাঠাগার। গ্রামের মানুষগুলো হলো বই। আর কলম হলো গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ। যা দিয়ে সে রচনা করতে পারে গীতাঞ্জলির মতো এক একটা গীতাঞ্চল।
জিন ইসলাম
ফাউন্ডার, হোপ বাংলাদেশ
লাইফস্টাইল বিভাগে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]