ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

আত্মগোপনে থাকাদের সংগঠিত করতে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলেন জঙ্গি রাকিব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০২৩
আত্মগোপনে থাকাদের সংগঠিত করতে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলেন জঙ্গি রাকিব

ঢাকা: আত্মগোপনে থাকা সদস্যদের সংগঠিত করতে গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবসহ (৩৪) তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।  

সম্প্রতি গাজীপুরের রাজেদ্রপুর এলাকায় র‌্যাবের চেকপোস্টে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তল্লাশি চালিয়ে সংগঠনের অর্থ শাখার প্রধান মো. মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবসহ শুরা সদস্য জাকারিয়া হোসাইন (২৯) ও মো. আহাদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে সিফাত ওরফে মামিদকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের তল্লাশি করে একটি বিদেশি পিস্তল ও নগদ ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী লিফলেট জব্দ করা হয়।

 

মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, নতুন জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব সংগঠনের কয়েকজন সদস্যসহ গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের দিকে যাচ্ছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার (৫ জুন) রাতে র‌্যাব-১ ও ৭ এর অভিযানিক দল গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় চেকপোস্ট স্থাপন করেন। পরে একটি সিএনজি অটোরিকশা তল্লাশি করে তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।  

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার রাকিব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান। তিনি ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থানকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ এক জঙ্গির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরে ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। পাশাপাশি গার্মেন্টস পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি বলেন, রাকিব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং সমতলের যাবতীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেন। আনসার আল ইসলাম থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা তার কাছে জমা ছিল। রাজধানীর মুগদা এলাকায় থাকাকালীন হিজামা সেন্টারের আড়ালে সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন রাকিব। ঢাকায় অবস্থানরত সকল শুরা কমিটির মিটিং তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো।  

এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া সংগঠনের শুরা সদস্য মায়মুনসহ অন্যান্যরা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে রাকিবের কাছে জমা রাখতেন। সংগঠনের অর্থায়নে মুন্সিগঞ্জে গবাদি পশুর খামার স্থাপন করেন রাকিব। তথাকথিত হিজরত করা অধিকাংশ সদস্য তার খামারে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করতেন এবং তখন তাদের শারীরিক কসরত ও তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করা হতো বলে জানা যায়।  

সংগঠনের আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, অস্ত্র ও রসদ ক্রয়সহ সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য অর্থ সরবরাহ করতেন এবং শুকনা খাবারসহ পাহাড়ে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে পার্বত্য প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠাতেন রাকিব। তিনি বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও সাংগঠনিক কাজে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়েছেন বলেও জানা যায়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সংগঠনের আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় সমতলের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন রাকিব। আত্মগোপনে থেকে তিনি সংগঠনের অন্যান্য আত্মগোপন করা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সংগঠনের সদস্যদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। আনসার আল ইসলামের সদস্য থাকায় ওই সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ ও সমন্বয় রাখতেন রাকিব।  

পাহাড় থেকে পালানোর সময় তার কাছে সংগঠনের প্রায় ২০ লাখ টাকা জমা ছিল। যার মধ্য থেকে সংগঠনের বিভিন্ন কাজে ইতোমধ্যে প্রায় ৭ লাখের বেশি টাকা খরচ করেছেন বলে জানা গেছে।  

গ্রেপ্তার জাকারিয়া ২০০৮ সালে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হিফজ সম্পন্ন করে ফরিদপুরে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন বলে জানা যায়। ২০২১ সালে সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগ দেন জাকারিয়া। পরিবারকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। পরে ২০২২ সালের প্রথম দিকে রাকিবের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি ও বাকলাইপাড়া হয়ে কেটিসিতে চলে যান। পাহাড়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন জাকারিয়া। পরে পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ত্যাগ করে সমতলে এসে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকেন। এরপর সংগঠনের আমীরের নির্দেশে রাকিবের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা সংগঠনের সদস্যদের একত্রিত করার জন্য টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গল এলাকায় যাওয়ার সময় র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে।    

গ্রেপ্তার অপর সদস্য আহাদুল কুমিল্লার একটি কলেজে অনার্স চতুর্থ সেমিস্টারে পড়ছেন। ২০১৮ সালে তার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সংগঠনের আমীর মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয় আহাদুলের। পরে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন আহাদুল। প্রথমে প্রায় দুই মাস আমীর মাহমুদের বাসায় অবস্থান করেন আহাদুল। তিনি আমীরের ব্যক্তিগত সহযোগীও ছিলেন। পরে মাহমুদের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি হয়ে কেটিসিতে চলে যান। পাহাড়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনিও।  

গ্রেপ্তার জঙ্গি সদস্যের সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।  

র‌্যাব জানায়, ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ জন তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। এই নিখোঁজের ঘটনায় তাদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব ফোর্সেস নিখোঁজদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র‌্যাব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় থাকার তথ্য পায়। র‌্যাব জানতে পারে যে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।     

২০২২ সালের অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইতোমধ্যে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ মোট ৭২ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও উগ্রবাদী বই।  

এছাড়াও উদ্ধার করা হয় সংগঠন সস্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও কন্টেন্ট। বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, এই সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সংগঠনের উপদেষ্টা শামীম মাহফুজ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিব।

এর আগে, র‌্যাব কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপপ্রধান মানিক, অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বায়ক মুনতাছির, দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ, বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ কমান্ডার দিদার হোসেন ওরফে চম্পাই গ্রেপ্তার হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০২৩
এসজেএ/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।