ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ভাদ্র ১৪৩১, ২৯ আগস্ট ২০২৪, ২৩ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

পানির ওপর ঘুম আসে না, অনেক কষ্টে আছি

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
পানির ওপর ঘুম আসে না, অনেক কষ্টে আছি

লক্ষ্মীপুর: আমরা অনেক কষ্টে আছি, থাকার জায়গা নাই, টয়লেট নেই, খাটের এক অংশ ভাঙা, আরেক অংশে কোনো মতে চেপে বসে আছি। সামান্য একটু জায়গায় কষ্ট করে ঘুমাই।

এরপরে কি ঘুম আসে? তোষক ভিজা, বালিশ ভিজা। পানির ওপর ঘুম আসে না। বলতে গেলে আসলে কোনো কিছুই নেই আমাদের। অবস্থা খুবই খারাপ।

মনের কষ্টে বাংলানিউজের কাছে কথাগুলো বলেন ষাটোর্ধ্ব নারী ফিরোজা বেগম।

প্রায় ১৮ থেকে ২০ দিন পানিবন্দি আছেন এই নারী ও তার পরিবার। দীর্ঘসময় পানিবন্দি থাকায় চলাফেরা, রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, পয়ঃনিষ্কাশন, সুপ্রেয় পানির অভাব, রোগবালাই এবং চরম অর্থ কষ্টে রয়েছে তার পরিবার।

ফিরোজার স্বামী আলী আকবর পেশায় একজন কৃষক৷ আয় ইনকাম এখন নেই।

বয়স্ক এই দম্পতির বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পশ্চিম জামিরতলী গ্রামে। তাদের বসতঘরে হাঁটু পানি, আর ঘরের চারপাশে কোমর পানি। মান্দারী-দিঘলী আঞ্চলিক সড়ক থেকে তাদের বাড়িটি কিছুটা দূরে। সড়ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত কোমর সমান পানি। বন্যা কবলিত এ দম্পতির এখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত।

বুধবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় এ দম্পতির বাড়িতে গিয়ে করুণ চিত্র দেখা গেছে। তাদের আশপাশের লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও তারা রয়ে গেছেন বাড়িতেই।  

সরেজমিনে দেখা যায়, এ নারী বসে আছেন একটি চৌকিতে। ঘরের ভেতরে এবং আশপাশে অথৈ পানি। পানির মধ্যে থাকা একটি চৌকিতে অসহায় অবস্থায় বসে আছেন ফিরোজা বেগম।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, খাওয়া-ধাওয়া নিয়ে অনেক কষ্টে আছি আমরা। রান্নার কাজ কীভাবে হয়- জানতে চাইলে পাশেই থাকা টেবিলের ওপর একটি গ্যাসের চুলো দেখিয়ে বলেন, এ চুলোতে কোনো রকমে একটু রান্না করি। এখন জান বাঁচানো ব্যাপার। চিড়ামুড়ি খেয়ে কাটাই। ত্রাণ হিসেবে মানুষে দিয়েছে, একটু খেয়ে জান বাঁচাই।

তিনি যে চৌকিতে বসে আছেন, সে চৌকি ছুঁই ছুঁই করছে পানি। যেকোনো সময় চৌকিতে পানি উঠে যাবে। তখন চৌকির এক কোনেও বসে থাকার মতো ব্যবস্থা হয়ত থাকবে না।

বলেন, ইট দিয়ে চৌকি উঁচু করে রেখেছি। ঘরে আরও দুটি চৌকি আছে, সেগুলো পানির নিচে। এ চৌকিটা শুধু ইট দিয়ে উঁচু করে নিয়েছি।

চারিদিকে শুধু পানি আর পানি থাকলেও খাবার পানির সংকট তাদের।

জানতে চাইলে ফিরোজা বলেন, খাবার পানি কেউ হয়ত এক বোতল দেয়। অল্প অল্প করে পান করি। দোকান থেকেও বোতল কিনে আনে।

এমন পরিস্থিতিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরার কথা জানিয়ে বলেন, পানিতে হাঁটতে হাঁটতে ঠাণ্ডায় অসুস্থ হয়ে গেছি।

গৃহস্থ এ পরিবারের অনেক হাঁস-মুরগি ছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে বেশ কিছু মুরগি।

এ বিষয়ে ফিরোজা বলেন, অনেক হাঁস-মুরগি ছিল, হঠাৎ পানি আসায় ডুবে মরে গেছে। কয়েকটা হাঁস আছে। কলা গাছের ভেলায় কোনো রকমে তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছি। খাবার ঠিকমতো দিতে পারি না। নিজেদের খাবারই জোটে না আবার হাঁস-মুরগির খাবার! নিজের পেট নিয়েই টানাটানি। তিনটা গরু আছে, কম পানির সময় পাশের বাড়িতে রেখেছিলাম। পানি বেশি হওয়ায় সড়কের পাশের একটি জায়গায় রেখে দিয়েছি। এ মুহূর্তে গরুর খাবার, হাঁস-মুরগির খাবার, মানুষের খাবার- সবই কঠিন হয়ে গেছে।

ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে এই নারী বলেন, এদিকে ত্রাণের গাড়ি আসে না। লোকও নামে না। মেম্বাররা দিছে, তা দিয়ে চলছে।

ফিরোজার স্বামী আলী আকবর বলেন, ঘরে আমার স্ত্রী আর ছেলে থাকে। রাস্তার পাশে গরু রাখা আছে, রাতে গরু পাহারা দিতে হয়। তাই আমি গরুর পাশেই থাকি। দিনে-রাতে মিলিয়ে বেশ কয়েকবার কোমর পানি মাড়িয়ে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে হয়। খুবই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু তো করার নেই। আয়-ইনকামও নেই। গরুর বাছুর আছে, দুধ বিক্রি করে কিছু টাকা পেতাম। কিন্তু এখন তো গরুকেই খাওয়াতে পারি না, দুধ দিবে কীভাবে?

পেশায় কৃষক আলী আকবর বলেন, চাষাবাদ করে চলি। কিন্তু এবার তো কোনো চাষাবাদ নেই। ছেলেদের আয়-ইনকাম নেই। সামনের দিকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে হয়ত।

লক্ষ্মীপুরে চলমান বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। এতে পানিবন্দি লোকজনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলেও বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে অনাগ্রহী। চরম দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বসবাস করছে এ জেলার পাঁচটি উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা। জেলার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি এলাকা এখনও পানির নিচে তলিয়ে আছে। দিন দিন পানির উচ্চতা বাড়ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।