ঢাকা: প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এবার স্বস্তিতে বাড়ি ফিরেছেন মানুষ। ঢাকা থেকে ছেড়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করতে আজও স্টেশনে হাজির হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
আজ ট্রেনে ঈদযাত্রার সপ্তম ও শেষ দিনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেলেও সময় অনুযায়ী চলছে প্রায় ৯৮ শতাংশ ট্রেন। ফলে স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রী জটলার দৃশ্য চোখে পড়েনি। বিগত যে কোনো ঈদের চেয়ে দুর্ভোগ কম পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। তাছাড়া শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলায় যাত্রী তথা রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বেশ খুশি।
জানা গেছে, শনিবার ভোর ৪.৪৫ মিনিট থেকে সকাল ১১ টা পর্যন্ত ২২ টি ট্রেন পূর্ব নির্ধারিত ট্রেনগুলো যথাসময়ে ছেড়ে যায়। এরমধ্যে রয়েছে বলাকা, তুরাগ এক্সপ্রেস, জয়দেবপুর কমিউনিটার, দেওয়ানগঞ্জ, ধূমকেতু, পর্যটক এক্সপ্রেস, পারাবত, নীলসাগর, সোনার বাংলা, সৈয়দপুর, তিশা, মহানগর প্রভাতী, সুনাদরবন, মহুয়া, বুড়িমারী, কর্ণফুলী, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর এক্সপ্রেস, একোতা, রুপসী বাংলা এক্সপ্রেসসহ মোট ২৩ টি ট্রেন।
রোববার (৩০ মার্চ) রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কমলাপুর রেল স্টেশনে একেকটি প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনে লোকে লোকারণ্য, কিছুটা দুর্ভোগ থাকলেও সবার মুখেই ছিল হাসি। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করেছেন। এসি-কোচ ছাড়া প্রতিটি কোচ যাত্রীতে পূর্ণ ছিল, এমনকি ভেতরে প্রবেশ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। শত শত যাত্রী ট্রেনের ছাদে বসে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন, যদিও রেলওয়ে কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। নকল টিকিটধারী যাত্রীদেরও প্রতিরোধের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ট্রেনই সময় অনুযায়ী চলছিল। মোট ৭১টি ট্রেনের মধ্যে ৪৬টি আন্তঃনগর ট্রেন। ঈদ উপলক্ষে কমলাপুর থেকে ৭১টি ট্রেন চলাচল করছে। ধূমকেতু, জামালপুর এক্সপ্রেস ও সিল্কসিটি এক্সপ্রেস নামের তিনটি ট্রেন ১০ থেকে ৩০ মিনিট বিলস্বে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে। এ ট্রেনগুলোর ছাদে যাত্রী উঠে পড়ে। পরে বহু চেষ্টার পর কিছুসংখ্যক যাত্রী ছাদ থেকে নামানো সম্ভব হলেও, বহু যাত্রী ছাদে চড়েই কমলাপুর ছেড়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ফিরতি যাত্রার জন্য একই ব্যবস্থাপনা রয়েছে। আশা করছি যারা বাড়ি গেছেন তারা স্বস্তিতে ফিরতে পারবেন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে যাত্রীদের চাপ একটু বেশি। আমাদের একটি ট্রেনে একটু সমস্যা হয়েছিলো সেটা লালমনিরহাট এক্সপ্রেসে। ট্রেনটিতে অতিরিক্ত যাত্রী ছিলো।
তিনি বলেন, যে সকল যাত্রী ট্রেনের ছাদে উঠেছে তাদের নামিয়ে টিকিট করিয়ে ট্রেনে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কেউ যেন ট্রেনের ছাদে না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু যাত্রীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে পড়েছেন। এখন যদি তাদের নামাতে গিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তার দায়ও আমাদের ওপরই আসবে।
সিডিউল বিপর্যয় নেই এ ক্ষেত্রে যমুনা রেল সেতু ও পদ্মা রেল সেতু ভূমিকা মুখ্য কিনা, না কি অন্য কোনো কারণ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অন্যতম একটা কারণ যমুনা ব্রিজে যে অতিরিক্ত সময় লাগতো সেটা সেভ হয়েছে। এছাড়া পদ্মাসেতু হয়ে কিছু ট্রেন চলাচল করছে। আমরা এবছর রাজনৈতিকভাবে বিশেষ কোনো ট্রেন দেই নি। কারণ এগুলো তেমন কোনো উপকারে আসে না।
এদিকে যাত্রীরা বলেছেন, ঈদে ফেরার সময়েও সরকারের কার্যকর তদারকি থাকলেও কোনো ভোগান্তি হবে না। পাশাপাশি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন যাত্রীরা।
জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রের যাত্রী মো: সোহাগ বাংলানিউজকে বলেন, ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য স্টেশনে এসেছেন। নারায়ণগঞ্জের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। পরিবারের সকলের সঙ্গে ঈদ করবে তাই বাড়ি যাচ্ছেন। মালিক ছুটি দেয় নি ফলে পালিয়ে চলে এসেছেন। পরে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন। ট্রেনের স্টেন্ডিং টিকিট কেটেছি ২০০ টাকা দিয়ে। অন্যান্য বছর অতিরিক্ত টাকা দিতে হতো দুই তিন জায়গায়। তারপরও টিকিট পেতাম না। এ বছরতো টিকিট পেয়েছি। তবে ট্রেনে কোনো সিট নেই দাঁড়িয়ে চলে যাবো। পথে সিট পেলে ভালো নইলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
কিশোরগঞ্জ যাবে মো: নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, গত ২০/২২ বছরেও এরকম সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা দেখি নাই। অন্যান্য বছর স্টেশনে এসে টিকিট পাইনি। ফলে লাইনম্যানরে টাকা দিয়ে প্লাটফর্মে আসতে হয়েছে। কিন্তু এ বছর ভিন্ন চিত্র যেই আসুক টিকিট পাচ্ছে তিন স্থানে চেক হচ্ছে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা নেই। ট্রেনও সময় মতো আসছে ও যাচ্ছে।
মো: সুজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। এবছর সব কিছু যেন ভালো লাগছে। কোনো ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। তবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ছাদের যাত্রী নামাতে হবে এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে। একই সঙ্গে ঈদে ফেরার সময়েও সরকারের কার্যকর তদারকি থাকলেও কোনো ভোগান্তি হবে না।
কমলাপুর রেলস্টশনের কর্মকর্তা (স্টেশন মাস্টার) আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, স্টেশনে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। ৪৬টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে ৩টি ট্রেন সামান্য বিলম্বে ছেড়েছে, তাও ছাদ থেকে লোক নামাতে গিয়ে কিছুটা বিলম্বে ট্রেন দুটি ছেড়ে যায়। সকাল ১১ টা পর্যন্ত মোট ২২ টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন রুটে ছেড়ে গেছে। এরমধ্যে ধূপকেতু ৩০ মিনিট দেরি করেছে, জামালপুর এক্সপ্রেস ১০ মিনিট ও লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ১০ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঈদযাত্রায় (শুক্রবার) যাত্রীদের ভিড় বেশি ছিল। স্টেশনের শুরু থেকে ট্রেনের গন্তব্য পর্যন্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। টিকেট যাচাইয়ের জন্য ভেরিফিকেশন করা হচ্ছে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ১২০টি আন্তঃনগর ট্রেনের পাশাপাশি ৫ জোড়া বিশেষ ট্রেন চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া লোকাল, কমিউটার ও মেইল ট্রেন স্বাভাবিকভাবে চলছে। পাশাপাশি ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখতে এবং যাত্রীদের সুবিধার্থে ঢাকাগামী ৯টি ট্রেনের বিমানবন্দর স্টেশনের যাত্রাবিরতি বাতিল করা হয়েছে। ঢাকামুখী ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামলাতে জয়দেবপুর স্টেশন থেকে ঢাকামুখী এবং ঢাকা স্টেশন থেকে জয়দেবপুরমুখী ট্রেনে টিকেট ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, ঈদযাত্রা নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উৎসবমুখর করতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। টিকিট কাউন্টার, প্ল্যাটফর্মসহ সব জায়গায় র্যাব, পুলিশ, আনসার সদস্যের পাশাপাশি রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি চোখে পড়েছে।
উল্লেখ্য, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগাম টিকিটে ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে গত ২৪ মার্চ। আজ ট্রেনে ঈদযাত্রার সপ্তম দিন। এবারের ঈদযাত্রায় ট্রেনের সূচি বজায় রাখা ও শিডিউল বিপর্যয় নিরসনে ঢাকাগামী ৯টি ট্রেনের বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাবিরতি বাতিল করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩০,২০২৫
জিসিজি/এমএম