জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত হতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গণভোটের সময়, প্রক্রিয়া এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এসব ইস্যুতে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
ঐকমত্যে আসতে না পেরে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে সমন্বয় করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে গণভোটের সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপারিশ দিতে বলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই প্রেক্ষিতে আগামী দুই-একদিনের মধ্যে কমিশন এ বিষয়ে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ দেবে।
বুধবার (০৮ অক্টোবর) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। দুপুরের পর শুরু হওয়া তৃতীয় পর্বের পঞ্চম দিনের এ বৈঠক রাত সাড়ে ১১টার দিকে শেষ হয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
জুলাই সনদকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে পাঁচ দিনের রাজনৈতিক সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দল এবং জোটের পক্ষ থেকে এই মত দেওয়া হয়েছে যে, দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিবেচনা করে যেন ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারকে এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট পরামর্শ দেয়। ঐকমত্য কমিশন এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞদের মতামত, গত পাঁচ দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, বিশেষত আজকের (বুধবার) যে মতামত দিয়েছে, সেগুলোকে সমন্বিত করে আমরা আগামী দুই-একদিনের মধ্যে আলোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেব। এবং এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোকে এ বিষয়ে আমরা অবহিত করব।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। এই সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সরকারকে পূর্ণাঙ্গ পরামর্শ পাঠানো হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে আমাদের যে মতামত দিয়েছেন, সেগুলো হলো—১) একটি আদেশ জারি করতে হবে; ২) ওই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে; ৩) গণভোটে দুইটা আলাদা প্রশ্ন থাকতে হবে—যেগুলোতে ঐকমত্য আছে সেসব বিষয়ে একটি এবং যেগুলোতে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট আছে সেগুলোতে একটি প্রশ্ন; ৪) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে এবং ৫) ওই আদেশের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোটে অনুমোদন সাপেক্ষে জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কার সমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। এই পাঁচটি বিষয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পেয়েছি।
গণভোটের সময়সহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের কথা তুলে ধরে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, সারাদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিভিন্ন রকম মত এসেছে। যেমন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আবার কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার মত দিয়েছে।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের মেয়াদ ১৫ অক্টোবর শেষ হবে। এর মধ্যেই তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চায়। তিন-চতুর্থাংশের বেশি দল ইতোমধ্যে অংশগ্রহণের আগ্রহ জানিয়েছে, এবং আশা করি বাকি দলগুলোর নাম অচিরেই পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতায় আগামী সাত দিনেই সব কাজ শেষ করতে। সবাই সহযোগিতা করলে আমরা ১৫ তারিখের মধ্যেই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করতে পারব।
অধ্যাপক রীয়াজ আরও জানান, কমিশন আগামী ১৮ থেকে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়ার সারসংক্ষেপসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এতে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সনদ প্রণয়নের ধাপ ও গণভোট প্রস্তাব পর্যন্ত অগ্রগতির বিবরণ থাকবে।
নিজেদের অবস্থানে অনড় বিএনপি-জামায়াত
গণভোটের সময়, প্রক্রিয়া, সাংবিধানিক আদেশ নাকি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট এবং নোট অব ডিসেন্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে গণভোটের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি আছে। এর আগে গণভোটের মতো মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে বলে মনে করে বিএনপি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একই দিনে গণভোট আয়োজন করাই হবে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত দাবি করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আগে আলাদা করে গণভোট আয়োজন করা ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও প্রশাসনিকভাবে জটিল হবে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে জনগণ একাধিক ব্যালটে ভোট দিতে পারবে—এটা আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়। এতে সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক জটিলতা সবই কমে যাবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ নিয়ে আলাদা গণভোট। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরে জুলাই সনদের ওপর গণভোট চায় দলটি।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হলে তা জটিলতা তৈরি করবে। অনেকে বলেছেন গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হবে, আমরা বলেছি—না, গণভোট একটি আলাদা বিষয়, জাতীয় নির্বাচন একটি আলাদা বিষয়।
তিনি বলেন, দুইটা ইলেকশন একসঙ্গে হওয়ার একটা ভালো দিক আছে, কিন্তু মন্দ দিক আছে অনেক বেশি... আপার হাউজের মতো কিছু ইস্যু আছে, যা আগামী নির্বাচনের অংশ হবে। যদি একই দিন করেন, তাহলে জনগণ গ্রহণ করবে কি করবে না—এটা আনডিসাইডেড রয়ে যাবে।
এ ছাড়া গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে হলে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে মন্তব্য করে ডা. তাহের বলেন, আমরা সবাই আশা করছি ভালো নির্বাচন হবে। কিন্তু কোনো কারণে সংসদ ইলেকশন যদি প্রশ্নবোধক হয়, তাহলে আপনার গণভোটের জুলাই সনদও প্রশ্নবোধক হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে জামায়াতের এ নেতা সাম্প্রতিক ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনের কথা তুলে ধরেন।
নির্বাচনী ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি আমাদের নিতে হবে... এটা মোটেই খুব বড় খরচ নয়, বরং জাতিকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে।
নোট অব ডিসেন্ট ইস্যুতে গণভোট নয়, সংসদে মীমাংসা চায় বিএনপি। এ প্রসঙ্গে দলটির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ভিন্নমত বা আপত্তি থাকলেও তা জুলাই সনদের অংশ হিসেবেই গণভোটে যাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এদিকে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে জামায়াত নেতা ডা. তাহের বলেন, মূলত একটি দলই কিছুটা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে—বিএনপি। তারা মানুষকে বলছে সংস্কার মানে, কিন্তু আবার অফিসিয়ালি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিচ্ছে। তাহলে জাতিকে পরিষ্কার করার জন্য তাদের বলতে হবে, তারা সংস্কার মানে কি মানে না।
তিনি বলেন, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ কোনো সিদ্ধান্তের অংশ নয়, বরং ব্যক্তিগত মতামতের রেকর্ড হিসেবে থাকে। একটা দলের নোট অব ডিসেন্ট তো জাতির ভোটের ম্যান্ডেটের জন্য কোনো সাবজেক্ট হতে পারে না।
সাংবিধানিক আদেশ নাকি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট এ নিয়েও একমত হতে পারেনি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী।
এ বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির প্রস্তাব করেন, জুলাই ঘোষণার ২২, ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদকে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে।
এ প্রস্তাবের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ৯৩ অনুচ্ছেদে কোনো সংবিধান আদেশ জারি করা সম্ভব নয়। তিনি পরামর্শ দেন, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ হিসেবে একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে। এরপর একটি অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে যাতে উল্লেখ থাকবে—সরকার জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য জুলাই সনদে গণভোট আয়োজন করবে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, এনসিপি সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের মাধ্যমে ১৩তম জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের পক্ষেই। তিনি বলেন, গণভোটে ইতিবাচক ফল এলে পরবর্তী সংসদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধনের ক্ষমতা পাবে।
অন্যদিকে, ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক শহীদুজ্জামান সেলিম অভিযোগ করেন, জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
সংলাপে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বুধবারের সংলাপে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি-সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ঐকমত্য কমিশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে ১৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত তারা তিন দফায় ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ আয়োজন করে এবং জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া প্রস্তুত করে।
এমইউএম/ইএসএস/এমজেএফ