ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরাই নিপীড়িত’

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২০
‘নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরাই নিপীড়িত’

ঢাকা: ‘নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরাই নিপীড়িত হচ্ছি’। আক্ষেপের সুরে এমন কথাই বললেন 'ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ' আন্দোলনের কর্মী আসমানী আক্তার আশা।

 

সারা দেশে অব্যাহত নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সম্মুখ সারির একজন আসমানী আক্তার আশা। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্র রাজনীতিতেও রয়েছে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজধানীর শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে তার জ্বালাময়ী স্লোগান আর ভাষণে অনুপ্রেরণা পান অনেক নারী।

বুধবার (১৪ অক্টোবর) রাতে বাংলানিউজের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তার সেই একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: আপনার হাত ভাঙলো কীভাবে? 
আশা: সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেই মিছিলের একদম সামনের সারিতে আমরা প্রায় ১৫ জন নারী ছিলাম। আমরা পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে পড়ি। নারী পুলিশ থাকলেও সেই মিছিলে আমাদের নারী সদস্যদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুরুষ পুলিশ সদস্যরা। আমার সঙ্গে তাদের ধাক্কাধাক্কি হয়, আমাকে তারা ধাক্কা দেয়, পেটেও ঘুষি মারে। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরাই নিপীড়িত হচ্ছি। সেদিন মিছিলে আমার হাত ভেঙে যায়।

বাংলানিউজ: ভাঙা হাত নিয়ে বিশ্রামের পরিবর্তে প্রতিদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে কষ্ট হয় না? এত সাহস আর অনুপ্রেরণার উৎস কী?
আশা: আমি কিন্তু হুট করেই এই আন্দোলনে যুক্ত হইনি। এটা আমার প্রথম আন্দোলনও না। আমার বাবা রাজনীতি করার ফলে অনেক ছোট থেকেই এ ধরনের আন্দোলনে এবং মিছিলে যাওয়া হয়েছে। বস্তুত আমার বাবা মাসহ অন্যান্যরা আমাকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন, তাতে এই সামান্য আঘাতে দমে যাওয়ার মতো মেয়ে আমি না। তারা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে লড়াই করতে হয়। দেখেন, ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের লাঠির আঘাতে আমার এক হাত ভেঙে গেছে। এতে আমার কষ্ট হলেও কিছুটা সুবিধাও হয়েছে। আমার ভাঙা হাত ঝুলিয়ে রাখার জন্য যে ব্যাগ ব্যবহার করছি, সেখানে একটা স্লোগান লিখে রাখতে পারছি। হ্যাঁ, আমার যে একেবারেই সমস্যা বা কষ্ট হচ্ছে না, তা নয়। রাতে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে, এই হাত দিয়ে আমি খেতেও পারি না। জামা কাপড় পরতে, চলাফেরা করতেও আমার কষ্ট হয়। কিন্তু আমি যখন এখানে এসে স্লোগান দেই, আমার সমস্ত কষ্ট বেদনা ভুলে যাই। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমি যখন থাকি, তখন আমার সেই কষ্টটা থাকে না। এই ভাঙা হাত দিয়েই তখন আমি দিব্যি মশাল ধরছি ও মাইক্রোফোন ধরে স্লোগান দিচ্ছি, এই শক্তিটা আমার ভেতর থেকে আসে। বলে প্রকাশ করা যাবে না, এটা এক ধরনের আবেগ এবং অনুভূতি বিষয়।

তারা ধর্ষকদের বিচার করছে না, বিচারের আওতায় আনছে না। কিন্তু আবার আমরা যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তারাই আমদেরকে বারবার বাধা দিচ্ছে। এতে বোঝা যায়, তারা ধর্ষকদের পাহারাদার। তাদের আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ে ধর্ষকরা সাহস পাচ্ছে। দোষটা ঠিক তাদেরও না, দোষ হচ্ছে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার। রাষ্ট্রযন্ত্র এর জন্যে দায়ী। তারা ওপর মহলের কথা অনুযায়ী চলে। তাদের যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি বক্তব্য দেন, পৃথিবীর কোন দেশে ধর্ষণ হয় না। সেখানে পুলিশের কাছ থেকে এমন আচরণ স্বাভাবিক ঘটনা।

বাংলানিউজ: ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা এবং প্রতিরোধ কতটা প্রয়োজন বলেন মনে করেন?
আশা: শুধু আইন করলেই ধর্ষণ থামবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগও করতে হবে। আমাদের ৯ দফা দাবিতে আমরা নৈতিক শিক্ষার কথা বলেছি। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের সম্মান জানানোর শিক্ষা দিতে পারি, তাহলে বড় হয়ে সেই সন্তান কিন্তু নারীদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখবে না। পাঠ্য পুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য বাদ দিয়ে, নারীর প্রতি সম্মানজনক বক্তব্যগুলো যদি যুক্ত করি, বিভিন্ন ধর্মীয় সভা সমাবেশ যেখানে নারী বিদ্বেষী কথা বার্তা প্রচার করা হয়, সেগুলো যদি বন্ধ করতে পারি, নারী বিদ্বেষী কথা বার্তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করি, তাহলে দেখতে পাই একদিকে যেমন আইনের প্রয়োজন আছে, ঠিক তেমনি সামাজিক সচেতনতা এবং নৈতিক শিক্ষারও প্রয়োজনও আছে। তাই সবকিছুর সমন্বয়েই আমরা ধর্ষণ রোধ করতে পারবো।

বাংলানিউজ: ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, এটাকে বিজয় হিসেবে দেখছেন কি না?
আশা: আমাদের আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমরা বলে আসছি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এর আগেও কিন্তু ধর্ষণ করে হত্যা করা হলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি ছিল। তারপরেও তনুকে, আফসানাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। আইনের সামান্য একটু পরিবর্তন করা হয়েছে, এতে খুশী হওয়ার কিছু নাই। এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, তখনই আমরা মনে করবো আমাদের আন্দোলনের সার্থকতা এসেছে।

বাংলানিউজ: ধর্ষণ ও নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন।
আশা: আমি নারী হিসেবে চাই, আমার জরুরি কোনো প্রয়োজনে কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে, আমি যত রাতেই বাসা থেকে বাইরে যাই, এই সমাজের কোনো পুরুষ যেন আমাকে লোলুপ দৃষ্টিতে না দেখে, বরং আমাকে তারা নিরাপত্তা দেবে ও সহযোগিতা করবে। কর্মস্থলে একজন নারীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হবে। এই সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যগুলো থাকবে না। আমি যখন আমার কোনো দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামবো, প্রশাসন তখন আমাকে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করবে। আমি চাই নারীবান্ধব একটি বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের স্বপ্নে ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। একইসঙ্গে এই রাষ্ট্রব্যবস্থারও পরিবর্তন চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২০
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।