ঢাকা, শনিবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ভুয়া নবাবের টার্গেট ছিল মাদ্রাসা শিক্ষকরা

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২০
ভুয়া নবাবের টার্গেট ছিল মাদ্রাসা শিক্ষকরা ভুয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী

ঢাকা: ঢাকার নবাব পরিবারের উত্তরাধিকারী পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন খাজা আলী হাসান আসকারী। তারা বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, দুবাইতে নিজেদের স্বর্ণের কারখানানা আছে বলেও প্রচার করতেন তিনি।

সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নার্স নিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়েছেন ভুয়া নবাব। প্রতারণার জন্য তার টার্গেট ছিল দেশের বিভিন্ন এলাকার মাদ্রাসার শিক্ষকরা।

ভুয়া নবাবের প্রকৃত নাম কামরুল ইসলাম হৃদয়। নাম পরিবর্তন করে নবাব বনে যাওয়া এই প্রতারকের উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকার নবাব এস্টেটের সম্পত্তি ভোগদখল করা। তদন্তের এক পর্যায়ে তার প্রকৃত পরিচয় উদঘাটন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যানাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতারণার কাজে হৃদয়কে সহযোগিতা করতেন মাওলানা সিরাজী নামে এক ব্যক্তি। তদন্তে ওই মাওলানার বাড়ি সাতক্ষীরা এলাকায় বলে জানা গেছে। বিভিন্ন এলাকার মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হৃদয়কে নাবাব বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন তিনি। এরপর হৃদয় ফেসবুকের মাধ্যমে মাদ্রাসার শিক্ষকদের টার্গেট করে চালাতেন প্রতারণা। জমি কিনে দেওয়া ও চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। আর টাকা নেওয়ার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দিতেন হৃদয়। এসব প্রতারণার অভিযোগে কামরুল ইসলাম হৃদয় ওরফে খাজা আলী হাসান আসকারীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী দুই মাদ্রাসা শিক্ষক রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানায় দুটি মামলাও দায়ের করেছেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, গ্রেফতারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে মুখ খুলছিলেন না প্রতারক কামরুল ইসলাম হৃদয় ও তার সহযোগীরা। খোঁজ করে হৃদয়ের আত্মীয়-স্বজনদের সন্ধান পাওয়া যায়। তার চাচাতো ভাই তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার প্রকৃত নাম কামরুল ইসলাম হৃদয়। তার মা নাইমা খাতুন মারা যাওয়ার পর বাবা আবদুস সালাম দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পরিবারে তারা সাত ভাই ও দুই বোন। হৃদয়ের ভাইদের মধ্যে দুই ভাই মারা গেছেন। এক ভাই আমিনুল ইসলাম কামরাঙ্গীরচরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। বাকি তিন ভাই মো. রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা, মো. আম্মদ আলী ও মো. বরকত আলী ওরফে রানা থাকেন হৃদয়ের সঙ্গে। তারা তিনজন হৃদয়ের সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন। এদের মধ্যে হৃদয়ের দেহরক্ষী হিসেবে রানা, ম্যানেজারের ভূমিকায় আহাম্মদ আলী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয়ে রাজা প্রতারণার কাজে ভূমিকা পালন করতেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারক কামরুল ইসলাম হৃদয় ওরফে আলী হাসান আসকারী মানুষজনকে বিদেশে পাঠানোর নামে মেডিক্যাল টেস্ট করার জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ‘ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ ও পল্টনের ‘মেডিনেট মেডিকেলে’ পাঠাতেন। এর জন্য মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি। এই কাজে প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা কমিশন পেতেন।

সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার ভুয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারীর আসল পরিচয় আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, তার নাম কামরুল হাসান হৃদয়। প্রতারণার জন্য তিনি আরও বেশ কয়েকটি নাম ব্যবহার করতেন।

তিনি আরও বলেন, ভুয়া নবাবের বিষয়ে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও আত্মসাত করা টাকার সন্ধান পেতে নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, পাসপোর্ট অফিসসহ সরকারের কয়েকটি বিভাগে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি।

গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়দানকারী খাজা আলী হাসান আসকারী (৪৮) সহ প্রতারক চক্রের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। প্রতারক চক্রের বাকি সদস্যরা হলেন- মো. রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা (৩৪), মীর রাকিব আফসার (২০), মো. সজীব ওরফে মীর রুবেল (৩৩), মো. আম্মদ আলী (৩৮) ও মো. বরকত আলী ওরফে রানা (৩২)।

প্রতারণার অভিযোগে হাসান আলী আসকারীর বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও মতিঝিল থানায় এবং আদালতে আরও তিনটি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, আলী হাসান আসকারী ২০১৪ সালে রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে নবাব খাজা আলী আহসান আসকারী নামে একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ নেন। এরপর ওই সনদ ব্যবহার করে ২০১৫ সালে তিনি ঢাকার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট তৈরি করেন। এরপর ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর দক্ষিণখান আদর্শ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী নামে একটি ওয়ারিশনামা সনদপত্র নিয়েছিলেন। সেখানে নিজের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন দক্ষিণখান চেয়ারম্যান বাড়ি।

তৎকালীন দক্ষিণখানের চেয়ারম্যান এস এম তোফাজ্জল হোসেন ওই ওয়ারিশ সনদে স্বাক্ষর করেন। পরে তিনি নিকুঞ্জ থেকে নেওয়া জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট দিয়ে ২০১৭ সালে নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী নামে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। সেই জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরেই চলতি বছর ঢাকা-১০ আসনের উপ-নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের হয়ে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আলী হাসান আসকারী। অন্যদিকে তার স্ত্রী সাহেবা হেনা আসকারী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনী ব্যানার, পোস্টার ও লিফলেটে ঢাকার নবাব পরিবারের পরিচয় উল্লেখ করেন প্রতারক এই দম্পতি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২০
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।