নারায়ণগঞ্জ: ৫৪০ বছরের পুরনো এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরের মন্ডলপাড়া এলাকায়। স্থানীয়রা মসজিদটিকে জিনের মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহের আমলে। সেই সময়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলাতেও নির্মিত হয়েছিল একই ধরনের আরও একটি মসজিদ। তবে বন্দরের শাহী মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করলেও শহরের মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের অভ্যন্তরের শাহী মসজিদটির বিষয়ে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কোনো নজরদারি নেই বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের ভেতরের এককোণে রয়েছে একটি ছোট আকারের এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটির গায়ে নির্মাণের সাল হিসেবে লেখা রয়েছে ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দ।
স্থানীয়দের অনেকেই জানান, মসজিদটি তারা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন। কেউ কেউ এটাকে জিনের মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আবার অনেকেই গায়েবী মসজিদ বলে থাকেন। মসজিদের মুসুল্লিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা মসজিদটিকে মুঘল আমলে নির্মিত শাহী মসজিদ বলে জানিয়েছেন।
পশ্চিম দেওভোগ পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ আলী বেপারী মসজিদটির নির্মাতাদের বংশধর দাবি করে জানিয়েছেন, তাদের বংশের পূর্বপুরুষ মুঘল আমলে কাজী ছিলেন। মসজিদের মুসুল্লিরা জানান, এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি আগে অনেক উঁচু ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে আশপাশের এলাকা উঁচু হওয়ায় মসজিদটি এখন নিচু হয়ে গেছে। স্থাপনার অনেক অংশ এখন মাটির নিচে চলে গেছে। ছোট মসজিদটিতে ৩টি কাতারে ২১ জন নামাজ পড়তে পারেন। জনশ্রুতি রয়েছে, এ ছোট মসজিদে জিনেরা নামাজ পড়ে।
স্থানীয়দের মতে, তাদের জন্মের পর থেকেই তারা এটিকে জিনের মসজিদ হিসেবে জানেন। এখানে জিনেরা নামাজ আদায় করে জিকির করে বলে আগে থেকেই চাউর রয়েছে। এ গম্বুজটি নিয়েও রয়েছে নানা রহস্য।
উইকিপিডিয়ায় বাংলার ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-এর নামে বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সূচনা ঘটে। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় পর্বের সর্বশেষ সুলতান ছিলেন জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ। তিনি ১৪৮১ থেকে ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত সুলতান ছিলেন। ফাতেহ শাহ কর্তৃক পরিচালিত কোনো সামরিক অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে মুদ্রা সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তার রাজ্য পূর্বে সিলেট ও দক্ষিণ পশ্চিমে দামোদর নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার শাসনামলে হাবশিরা দরবারে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থান লাভ করে। ১৪৮৭ সালে হাবশি প্রাসাদরক্ষীদের প্রধান তাকে হত্যা করে বাংলায় হাবশি বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের সমাপ্তি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে (৮৮৬ হিজরি) সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দরে দুটি শাহী মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। যার মধ্যে একটি হচ্ছে শহরের মন্ডলপাড়া এলাকায় এবং অপরটি হচ্ছে বন্দরের সালেহনগর এলাকায় অবস্থিত শাহী মসজিদ। দু’টি মসজিদই এক গম্বুজবিশিষ্ট। তবে বন্দরের শাহী মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করলেও শহরের মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের ভেতরে মসজিদটির বিষয়ে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কোনো নজরদারি নেই বলে জানা গেছে।
শাহী মসজিদ দু’টি সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহের শাহী-কর্মকর্তা মালিক আল-মুয়াজ্জম বাবা সালেহ সালেহ ইয়ামেনী (র.) নির্মাণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তিনি ছিলেন মক্কা’র উচ্চ বংশীয় একজন মহাজের। সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহের রাজত্বকালে তিনি রাজপদ’স্থ কর্মচারী ছিলেন। বন্দরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। হাজী সালেহ বাবার মাজার এখানেই অবস্থিত। এ মহান ব্যক্তির নামে সালেহনগর নামে একটি এলাকার নামকরণ করা হয়েছে। বন্দরের শাহী মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার এবং একটি বিশাল আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকের দেয়ালে এখনও রয়েছে শিলালিপি।
মসজিদটি বর্গাকার। অভ্যন্তর ভাগে ছয় দশমিক ২০ মিটার এবং বহির্ভাগে নয় দশমিক ৭০ মিটার। মসজিদটিতে তিনটি নকশাখচিত অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব আছে। মাঝখানের মিহরাবটি অন্য দুটির তুলনায় বড়। মসজিদটি ঘিরে গড়ে উঠেছে তিন তলাবিশিষ্ট নতুন মসজিদ ও মাদ্রাসা। মূল মসজিদটি এখন আর ব্যবহৃত হয় না। দক্ষিণে রয়েছে চতুর্ভূজী একটা ঐতিহ্যবাহী পুকুর, যা মসজিদের আওতাধীন। পুকুরটিতে চতুর্দিকে সিঁড়ি ও ঘাট বেষ্টিত রয়েছে। তবে পুকুরটিও দিনে দিনে ভরাট হয়ে ময়লা পানির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
এমআরপি/এসআইএ