ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অফবিট

গোপন লড়াইয়ে ভাষা রক্ষা! 

অফবিট ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭
গোপন লড়াইয়ে ভাষা রক্ষা!  ১৯১৪ সালে সান সেবাস্তিয়ান উপকূলীয় শহরে চালু প্রথম বাস্ক স্কুল বা ইস্কটলা। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের পাইরেনিস পর্বতমালার পশ্চিম কোণে অবস্থিত স্পেনের বাস্ক দেশ আসলে আলাদা কোনো দেশ নয়, দেশটির সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত ১৭টি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের একটি। এখানে আদিবাসী ভাষাগত গোষ্ঠী বাস্ক জাতির বাস, যাদের ভাষাও বাস্ক বা ইস্কারা। 

স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো স্পেনের ক্ষমতা দখলের পর প্রাচীন ইস্কারা ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও বাস্ক দেশের বাসিন্দারা তা গোপনে টিকিয়ে রেখেছেন।  

ফ্রাঙ্কো তার শাসনামলে ও জীবোদ্দশায় ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্প্যানিশ ভাষার প্রসারের লক্ষ্যে বাড়ির বাইরে বাস্কসহ অন্য আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও শিক্ষা নিষিদ্ধ করে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেন।

 

কিন্তু বাস্করা বহু বছরের গোপন লড়াইয়ে প্রাচীন ভাষাটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে শুধু রক্ষাই করেননি, ছড়িয়েও দিয়েছেন। যার ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় অন্য ভাষার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন কয়েক হাজার বছরের রহস্যময় ভাষাটি দোর্দণ্ড প্রতাপে চলমান।  বাস্ক শব্দগুলো রাস্তা চেনানো ও ঘরের দরজাগুলোতে প্রদর্শিত হয়।  ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত


এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- বাবা-মায়েদের নিয়ে লুকিয়ে বাস্ক স্কুল বা কস্টোলার প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৪ সালে প্রথম স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ এই গোপন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ছিল।  

বাস্ক সংস্কৃতিতে ফ্রাঙ্কোর আক্রমণের সময় ১৯৬০ এর দশকে ইটিএ (বাস্ক হোমল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম) গঠন করে স্পেন থেকে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীন হওয়ার আন্দোলন শুরু হয়। শত শত মানুষকে হত্যা করা ছাড়াও চাঁদার দাবিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ধনীদের কাছে চিঠি পাঠায় সশস্ত্র সংগঠনটি।  হুমকি দিয়ে লেখা এসব চিঠি ও দেয়ালের স্লোগানগুলোও বাস্ক ভাষায় লেখা। ইটিএ মাত্র গত এপ্রিল মাসে নিরস্ত্র হয়েছে।

ফ্রাঙ্কোর নিষিদ্ধ করা সেই ইস্কারাই এখন বাস্ক অঞ্চলটির স্বায়ত্বশাসিত সম্প্রদায়টিতে ছাড়াও পুরো স্পেন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রান্স জুড়ে প্রচলিত। বাস্ক দেশের সমস্ত টেলিভিশন-রেডিও ও সংবাদপত্রগুলোতে কথিত, মুদ্রিত ও প্রচারিত এবং বাস্ক ভাষার গান পরিবেশিত হয়। এর শব্দগুলো রাস্তা চেনানো ও ঘরের দরজাগুলোতে প্রদর্শিত হয়, দোকান ও রেস্টুরেন্টে খাবার  পরিবেশন ও স্বাগত জানানোর ভাষাও এটি।  


২১ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৬ জন বাস্কবাসীর ৩৫ শতাংশ বা ৭ লাখই স্বতন্ত্র বাস্ক ভাষায় কথা বলেন এবং এটি তাদের জন্য গর্বের। অঞ্চলটির মধ্যযুগীয় মাছ ধরার গ্রাম গ্যাটেরিয়ায় এর অনন্য ব্যবহার রয়েছে।

রেস্তোরাঁ ও সৈকতের জন্য সুপরিচিত বাস্ক শহর গ্যাটেরিয়া ও সান সেবাস্তিয়ানে ইস্কারা ভাষার মহিমাময় গান বিখ্যাত হয়েছে। বিশেষত বাইসে উপসাগর বরাবর ২৬ কিমি পূর্বের সান সেবাস্তিয়ানের পুরনো অংশে অষ্টাদশ শতকের শতকের একটি রেস্তোরাঁয় সুরেলা কণ্ঠস্বরের পুরুষ বাস্ক গায়করা বেশ জনপ্রিয়।  

অঞ্চলটির সমস্ত সংবাদপত্র বাস্ক ভাষায় মুদ্রিত হয়।  ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীতপাইরেনিস পর্বতমালার বিস্কা উপকূল বরাবর বিচ্ছিন্ন শহর ও খামারের মধ্যেও ইস্কারায় কথা বলা হয়, যেখানে এটি কয়েকটি পরিবার জানতো। কিন্তু শহরগুলোতে এটি নিঃশব্দ হয়ে পড়েছিল, যেখানকার অবহেলিতরা এমনকি ইস্কারায় কথা বলা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পুলিশে পর্যন্ত খবর দিয়েছিলেন।

১৯৪০ সালের একদিনের ঘটনা সেটি। বাস্কের সবচেয়ে জনবহুল শহর বিলবাওয়ের ৩৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের সমুদ্র তীরবর্তী ছোট বারমো গ্রামে যান জাতীয়তাবাদী নেতা কারমেল এরেক্যাটক্সোর দাদা। সেখানে বিলবাওয়ের খাদ্য বিক্রেতাদের সঙ্গে ইস্কারায় কথা বলায় তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং তিনি জরিমানা দিতে বাধ্য হন।  

প্রতিবাদে এরেক্যাটক্সোকে নিষিদ্ধ ইস্কারা ভাষা শেখান তার দাদা ও বাবা। ১৯৭০ এর দশকে শিশু বয়সে কারমেল এরেক্যাটক্সো বিলবাওয়ের একটি গির্জার বেসমেন্টে ইটিএ’র গোপন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানেই নিষিদ্ধ ইস্কারা ভাষা শেখেন তিনি। বিখ্যাত গগেনহেইম জাদুঘরও এ শহরেই অবস্থিত।  

কারমেল এরেক্যাটক্সো বলেন, ‘ভয় ছিল, ইস্কারায় কথা বলা অনেক পরিবার ভাষা হারিয়েছে। হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আসায় এ ভাষা কিছু প্রজন্মের মধ্যে স্থানান্তরিতও হয়নি’।  

‘কিন্তু সে ভয় ছিল অমূলক। এমনকি আন্দোলনের একটি অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে ইস্কারাকে, এটি রাজনৈতিক ও ছদ্মবেশিত হয়ে ওঠে। ভাষার বিরুদ্ধে নিপীড়নের প্রতিক্রিয়াও ছিল স্বাধীনতার লড়াই। ধারণা রয়েছে, ইস্কারা কেবল জাতীয়তাবাদীদের। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এ ভাষা সার্বজনীন’।  

‘ভাষা একটি স্থানের পরিচয়। একনায়ক ফ্রাঙ্কো জানতেন যে, ইস্কারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বিলবাওয়ের একজন শিক্ষকও তার শ্রেণিকক্ষে এ ভাষায় কথা বলেন। যদি আপনি কোনো জায়গা থেকে ভাষা গ্রহণ না করেন, তবে এটি মারা যায়’।  

বিলবাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্ক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর পেলো সালাবুরু বলেন, ‘১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর বাস্ক ভাষার স্বীকৃতি তার বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। অনেক লোক বাস্ক শিখতে শুরু করেন এবং ভাষাটির যত্ন নেন’।  


ইস্কারাকে টিকিয়ে রাখতে স্প্যানিশ বাস্ক দেশটির সরকার ভাষার ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সম্প্রতি প্রচারাভিযানও শুরু করেছে। এজন্য একটি ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখানে ইস্কারাভাষিরা অনুশীলন করতে পারেন। এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ইস্কারা, স্প্যানিশ বা উভয় ভাষায় পড়তে চায় কি-না- তাও বেছে নিতে পারে। বেশিরভাগই ইস্কারা শিখতেই বেছে নেয়।  

প্রফেসর সালাবুরু বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনেক লোক রয়েছেন, যারা বাস্ক জানেন, স্প্যানিশ ভাষায়ও কথা বলতে পছন্দ করেন’।  

‘বাস্করা মনে করেন যে, ভাষা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা মানুষ হিসেবে তাদের চিহ্নিত করে। তারা এটি হারাতে চাননি। কিন্তু আমি বলবো যে, মানুষ যেমন বলেছেন, তেমন বিচ্ছিন্নও নন তারা। কারণ, হাজার হাজার বছর ধরে অসংখ্য মানুষ এই ভূখণ্ডটি ব্যবহার করেছেন’।  


বাংলাদেশ সময়: ০৪১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।