ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হোক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ

ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম | সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
আপডেট: ১০:০৩, অক্টোবর ২, ২০২৫
জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হোক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় মতবাদ আজ ইতিহাস ও বাস্তবতার কশাঘাতে সম্পূর্ণ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তাদের আদর্শের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর রাজনৈতিক ইসলাম তত্ত্বের ওপর।

কিন্তু এই তত্ত্ব ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, ছিল সাংঘর্ষিক। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, মানবকল্যাণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা সর্বাধিক গুরুত্ব পায়।

অথচ মওদুদী ইসলামকে সীমিত করে ফেলেছিলেন এক রাজনৈতিক আন্দোলনের সংকীর্ণ পরিসরে। তিনি ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে। এ কারণেই তাঁর মতবাদ ইসলামী বিশ্বে কোনো দিন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া মওদুদীকে তাঁর নিজ দেশেই একজন স্বীকৃত ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।

তাঁর ব্যাখ্যাকে আলেমসমাজ ইসলাম বিকৃত করার প্রয়াস বলেই আখ্যা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের মতো একটি দেশে, যেখানে শরিয়াহভিত্তিক শাসনের দাবি করা হয়, সেখানে পর্যন্ত মওদুদীর সব বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট প্রমাণ করে, তাঁর চিন্তাধারা ইসলামের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য নির্মিত হয়েছিল। কোনো রাষ্ট্র, কোনো মুসলিম সমাজই তাঁকে একজন গ্রহণযোগ্য ইসলামী মনীষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

এই ভ্রান্ত মতবাদের উত্তরাধিকার বহন করে আসছে জামায়াতে ইসলামী। তাদের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ই সাক্ষ্য দেয়, তারা বারবার মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের প্রবণতায় লিপ্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষ রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস ও ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু এই আবেগকে ভোটব্যাংক ও রাজনৈতিক সমীকরণের হাতিয়ার বানানো নিছক দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। জামায়াতে ইসলামী মসজিদ, মাদরাসা ও ওয়াজ মাহফিলকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ হিসেবে।

কোরআন ও হাদিসকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেছেন তাদের তাত্ত্বিক গুরু মওদুদী সাহেব। তাদের বর্তমান নেতৃত্বও জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ ইসলাম মানুষের হৃদয়ের পবিত্র অনুভূতিকে রাজনীতির সিঁড়ি বানাতে দেয় না। ইসলাম চায় সমাজে শান্তি, সমতা, সহমর্মিতা ও কল্যাণ। জামায়াতে ইসলামী সেই শিক্ষাকে বিকৃত করেছে ক্ষমতার লোভে। তাদের রাজনৈতিক চরিত্র ভঙ্গুর ও নীতিহীন। কখনোই তারা একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কৌশলের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ইতিহাসে দেখা যায়, একবার পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা, আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া, পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকদের ছায়াতলে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট—প্রতিবারই তারা নিজেদের অবস্থান পাল্টেছে।

তাদের নামের সঙ্গে ইসলাম শব্দটি যুক্ত থাকলেও বাস্তবে তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাজনীতি চালিয়ে এসেছে। তারা ইসলামকে নিজেদের ব্র্যান্ড বানাতে চেয়েছে, অথচ ইসলামের মহত্ত্বকে কখনো ধারণ করেনি। এই বাস্তবতায় বিএনপির অবস্থান বিশ্লেষণ করা জরুরি। বিএনপি অতীতে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনী জোটে নিয়েছিল। বাস্তবতা হলো, জামায়াতের সঙ্গে জোট করা বিএনপির গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করেছে এবং মানুষের আস্থায় কমবেশি আঘাত হেনেছে।

বিএনপির শক্তির উৎস হলো বাংলাদেশের জনগণ ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি দর্শন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আবেগকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, আবার সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শহীদ জিয়া সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিলেন মুসলমানের আবেগকে ধারণ করার জন্য। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এমন একটি দর্শনে, যেখানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায় সমান মর্যাদায় বসবাস করতে পারে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ কোনো বিভাজন নয়, বরং একত্রীকরণ বা ইনক্লুসিভনেস। এই দর্শনই বাংলাদেশের জাতিসত্তাকে সুদৃঢ় করেছে।

জামায়াতের বিভাজনমূলক রাজনীতি ও শহীদ জিয়ার জাতীয়তাবাদী দর্শনের মধ্যে এখানেই মূল পার্থক্য। জামায়াত যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার স্বার্থে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেখানে ধর্মকে মর্যাদা দিয়ে জাতীয় ঐক্যের ভিত নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। এ কারণে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আজ এবং আগামী সময়ের জন্যও প্রাসঙ্গিক। এটি ধর্মীয় অনুভূতি ও নৈতিকতার সমান্তরালে থেকে একটি ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর বাংলাদেশে আবারও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছে। এখানে সুস্পষ্টভাবে একটি কথা বলা জরুরি, বর্তমান বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোনো প্রকার রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। অতীতে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, আজ সেটি অনিবার্য নয়।

বিএনপি নিজস্ব এজেন্ডা ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের এজেন্ডা হলো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, আইন ও ন্যায়ের শাসন কায়েম করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। এই পথচলায় জামায়াতের মতো বিতর্কিত, ইতিহাসে কলঙ্কিত দলের কোনো স্থান নেই।
ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপি প্রমাণ করেছে যে তারা একক শক্তি হিসেবেই জনগণের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, নতুন প্রজন্মের উত্থান, তরুণসমাজের আকাঙ্ক্ষা—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আজ বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী এখানে কোনো জায়গা পায়নি, পাবেও না। কারণ জনগণ জানে, তাদের প্রকৃত স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কেবল সেই দল, যারা শহীদ জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের সংগ্রামে অবিচল থাকে এবং প্রতিটি নাগরিককে তাদের প্রাপ্য সমান অধিকার দেয়।
অতএব বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ, তাদের রাজনীতি দ্বিচারিতাপ্রসূত এবং তাদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্কে কলুষিত।
অন্যদিকে বিএনপি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে, আত্মসমালোচনার পথ বেছে নিয়েছে এবং আজ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্তে অগ্রসরমাণ। শহীদ জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আবেগের মর্যাদা এবং অন্যান্য ধর্মের নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। বর্তমান বিএনপি জামায়াতমুক্ত, তারা নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ পথেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.), নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।