ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

দুই সাক্ষাৎকারেই দেশবাসীর হৃদয় জয় তারেক রহমানের

মাহবুব আলম |
আপডেট: ১৫:৪৩, অক্টোবর ৯, ২০২৫
দুই সাক্ষাৎকারেই দেশবাসীর হৃদয় জয় তারেক রহমানের তারেক রহমান

তারেক রহমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা স্বপ্নবাজ সফল রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের পুত্র। পুত্র আপোসহীন নেত্রী চার চারবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার।

শুধু তাই নয়, নিজেও জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার। এখানেই শেষ নয়, দেশ থেকে অনেক দূরে সুদূর প্রবাস থেকে তিনি হাসিনাবিরোধী গণআন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী নেতা। তারপরও তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে অনেকের মাঝে বিভেদ বিভ্রান্তি আছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর তাৎক্ষণিকভাবে দেশে না আসার জন্য।

বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ দেশবাসী, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা আশা করছিলেন তারেক রহমান দেশে ফিরে নব উদ্যোগে দলের নেতৃত্ব দেবেন। আর তাই তাদের নেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিন ঢাকায় কী অবস্থা হবে, কী অবস্থা করবেন তা নিয়ে তারা নানান চিন্তা-ভাবনা ও জল্পনা-কল্পনা করেন। এই চিন্তা-ভাবনা ও জল্পনা-কল্পনা ছিল এমন যে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিন ঢাকায় বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ জনতার ঢল নামবে। অনেককে এ কথাও বলতে শুনেছি, বিমানবন্দর থেকে নয়াপল্টন, বিএনপি অফিস পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। জনতার ঢলে ঢাকা অচল হয়ে যাবে। যা এদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ঘটনায় পরিণত হবে। কিন্তু না, তা হয়নি। হয়নি কারণ তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরেননি। এমনকি ১২ মাস পরেও দেশে ফেরেননি। আর তাই তার নেতৃত্ব নিয়ে, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানামুখী প্রশ্ন ও গুঞ্জন শুরু হয়। এমনকি তার নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এই প্রশ্ন ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের যার যার অবস্থান থেকে শিগগিরই তিনি দেশ ফিরবেন বলে বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই শিগগিরই মাসের পর মাসেও শেষ হয়নি। তাই তো অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি এমনকি তার নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। এমনকি অনেকের মাঝে কিছুটা হলেও হতাশা দেখা দেয়।

শেষ পর্যন্ত সেই হতাশা ও প্রশ্নের জবাব মিলেছে তারেক রহমানের সদ্য প্রদত্ত দুটি সাক্ষাৎকারে। প্রথম সাক্ষাৎকারটি বিবিসিকে দেওয়া। পরেরটি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে।

উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে থাকলেও তিনি কোনো গণমাধ্যমকে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, স্বৈরাচার সরকারের সময় আদালতের মাধ্যমে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

যাই হোক প্রায় দুই যুগ পর মাত্র দুই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বাজিমাত করে দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন—“বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি হো তো থোড়া থোড়া”। সত্যিই তাই! তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বাবা জিয়াউর রহমান ও মা খালেদা জিয়ার যোগ্য উওরসূরি।

এটা তার প্রথম সাক্ষাৎকারেই তিনি প্রমাণ দিয়েছেন। শুধু কথা বলার ঢং বা শব্দচয়নেই নয়, তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়া ও খালেদা জিয়ার পুত্রই নন, তিনি এখন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মেধা, যোগ্যতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সব দিক দিয়েই তিনি পুরোপুরি একজন রাজনীতিক।

অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা যেভাবে তুখোড় সাংবাদিকদের মোকাবিলা করেন, ঠিক সেভাবেই তিনি সাংবাদিকদের মোকাবিলা করেছেন, প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ধীর-স্থির, বুদ্ধিদৃপ্তভাবে। বিশেষ করে উত্তরাধিকারের রাজনীতি, পরিবারিক রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে। আর তাই তো তিনি দেশ বিদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সকল মহলের প্রশংসায় ভাসছেন।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচন ও সরকার গঠন প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেছেন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমরাই জয়ী হব। আমরা বিশ্বাস করি যে, এককভাবে সরকার গঠনের অবস্থায় আমরা আছি। ” এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, “আমরা অন্যান্য দলকে নিয়েও সরকার গঠনে প্রস্তুত। এসব দলের মধ্যে গত বছর গণঅভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটা নতুন দলও রয়েছে। ” তিনি বলেন, “আমরা তাদের রাজনীতিতে স্বাগত জানাব। তারা তরুণ, তাদের ভবিষ্যৎ আছে। ” খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। সুদূর প্রবাসে থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতি এই আস্থা, ভরসা ও ভালোবাসা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে।

এই সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করেছেন তারা চান স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে যারা আন্দোলন করেছেন তাদের সকলকে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করবেন। এক কথায় বলেছেন, “কমবেশি সবাইকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে চাই। ” বিএনপি যেখানে এককভাবে সরকার গঠনের অবস্থায় আছে সেখানে সকলকে নিয়ে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের বক্তব্য যেকোনোভাবেই বিচার করা হোক না কেন—এটা রাষ্ট্রনায়কসুলভ, নেতৃত্বসুলভ বক্তব্য।

সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যের অন্যতম দিক হলো, তিনি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, “বিএনপি সরকার প্রতিহিংসার বৃত্ত ভেঙে দেবে“। এটা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতির একটা বড় বিষয়। আমরা দেখি তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় থাকলে দেশপ্রেমিক আর ক্ষমতায় বাইরে থাকলে সকলেই দেশদ্রোহী। আর তাই তাদের বিরুদ্ধে দমন পীড়ন ও নির্যাতন নেমে আসে। আবার দমন পীড়ন নির্যাতনের শিকার দল ক্ষমতায় গেলে তারা সেই দমন পীড়ন নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়। প্রতিহিংসার রাজনীতি করে। তারেক রহমান যে, বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন, এটা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য।

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আগামী দিনের সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে একদিকে যেমন অর্থনীতি অন্যদিকে দুর্নীতির কথা বলেছেন। দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছেন, “এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই সময় লাগবে। আমি এখন যত কথাই বলি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে—এই বিষয়টি আমাদের কাজে প্রমাণ দিতে হবে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, আমরা যাতে এমন একটি অবস্থা তৈরি করতে পারি, যেখানে আমরা বিশ্বের অন্য দেশের সামনে কিছুটা হলেও যাতে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি। ” এমন স্পষ্ট কথা কজন নেতা বলতে পারেন? সধারণত তৃতীয় বিশ্বের নেতারা বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি দূর করব। দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের সরকারের নীতি হবে জিরো টলারেন্স।  

স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এমনকি ক্ষমতায় থেকেও প্রায়শই বলতো, দুর্নীতির বিষয়ে তার সরকারের নীতি হচ্ছে জিরো টলারেন্স। অথচ তার সরকারের সময় বাংলাদেশ বছরের পর বছর দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের তকমা লাভ করেছে। হাসিনা ও হাসিনা পরিবার নিজেই দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। দেশের অর্থর্নীতি পঙ্গু করে দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকাও লুটপাট করেছে। এই অবস্থার মধ্যে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান দুর্নীতি বিষয়ে যে ধ্যান ধারণা ও কর্মপন্থার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা আশাব্যাঞ্জক।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সবকিছুর আগে বাংলাদেশ’। এটাই হবে বিএনপির সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। ঐতিহাসিকভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন জুগিয়ে আসা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এতদিনের সম্পর্ককে ‘একপক্ষীয়’ হিসেবে বর্ণনা করে একে নতুন ভাবে শুরু করার কথা বলেছেন।

গণহত্যাকারী দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে বলেছেন, “অন্যায়কারীর বিচার করতে হবে। সেটি ব্যক্তি হোক বা দলই হোক। যারা জুলুম করেছে, তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে, দলও হতে পারে। ”

সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে অসাধারণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান শেষ হয়নি। এটি এখনো চলমান। দেশে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থান শেষ হবে না। সম্পূর্ণ হবে না। তার এই উপলব্ধি দেশের রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তার নতুন দিক খুলে দেবে বলে আশা করি। কারণ ইতোমধ্যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান এখন অতীতের বিষয় বলে ধারণার জন্ম নিয়েছে। এই অভ্যুত্থানকে তারা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা করে ওই অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। অথচ ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যে, এযাবৎকালে সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান, যে গণঅভ্যুত্থানে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, তা তারা ভুলেই বসে আছেন। কিন্তু লক্ষণীয় দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লন্ডনে বসে তারেক রহমান ঠিক তার উল্টো। তিনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সঠিক মূল্যায়ন ও বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন। আর তাই তো তার সাক্ষাৎকার নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলসহ সকল মহলের প্রশংসায় ভাসছেন তারেক রহমান। সবাই বলছেন, তার মধ্যে পাশ্চাত্য নেতৃত্বের ছাপ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক।

মাহবুব আলম: লেখক ও সাংবাদিক।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।