ঢাকা, শনিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

শুধু কথা নয় কাজেও প্রমাণ চাই

ফাইজুস সালেহীন, সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৬, অক্টোবর ১০, ২০২৫
শুধু কথা নয় কাজেও প্রমাণ চাই ফাইজুস সালেহীন

বিবিসির সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশংসায় ভাসছেন তারেক রহমান। অতীতে যারা বিএনপির এই নেতার ধ্যানধারণা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন তাদেরও অনেকে মনে হয় কিছুটা থমকালেন? তারা আপনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন, এই কি সেই তরুণ তারেক রহমান; বাংলাদেশের বাতাসে ভাসমান বদনামের অন্ত ছিল না যাঁর! সুশীলের চায়ের টেবিলে, দলকানা সাংবাদিকের আড্ডায়, এমনকি গ্রামের চায়ের টং দোকানেও তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন নিয়ে শোনা গেছে মুখরোচক নানান গল্পকাহিনি।

ওয়ান-ইলেভেনে ভয়ংকর একটি সরকার ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর বদনামের বাতাস তীব্র গতি লাভ করেছিল। মাইনাস টু ফর্মুলার বাস্তবায়ন ও পরিবারতন্ত্র অবসানের নাম করে গোয়েবলসীয় কায়দায় হাওয়া ভবনের ওপর ফোকাস করা হয়েছিল। টেলিভিশনের টক শোর টকারদের অনেকে দুর্নীতিবিরোধী সাধু-সন্ত কিংবা সংস্কারবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। তথ্যের প্রবাহ ছিল; তবে সেটা ছিল একমুখী- ফ্রম দ্য গভর্নমেন্ট টু দ্য পিপল। ভায়া সংবাদপত্র ও টেলিভিশন। তখন ফেসবুক, ইউটিউব, কিংবা এক্স হ্যান্ডেল-এসবের কিছুই ছিল না। থাকলে তথ্যের বিপরীত স্রোতও থাকত। কিন্তু সেটা ছিল না। কাজেই রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চলেছে অবাধে। পত্রিকা ও টেলিভিশনে বায়াসড রিপোর্ট ও মন্তব্যের অভাব ছিল না। কম বেশি সব নেতার বিরুদ্ধেই তখন অপপ্রচার হয়েছে।

বিএনপি যেহেতু ইমিডিয়েট পাস্ট গভর্নমেন্ট ছিল, ফলে এই দল ও তারেক রহমানকে ঘায়েল করা সহজ ছিল। অপতথ্যের প্রচারণা এতটা শক্তিশালী ছিল যে ২০০৮ সালের ইলেকশনে বিএনপি ধারণার চেয়েও খারাপ ফল পেয়েছিল। নেতা-কর্মীদের নৈতিক শক্তিও হ্রাস পেয়েছিল। এগুলো সেদিনের কথা। রাখঢাক করে লাভ নেই। পর্যালোচনা করতে হবে। দুর্বলতা চিহ্নিত করতে হবে শক্তিশালী ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য।

বিবিসির সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার বাস্তবিক অর্থেই অনন্যতার দাবি করতে পারে। সাক্ষাৎকারের প্রায় পুরোটাই শুনেছি এবং টেক্সটও পড়েছি। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যে পরিমিতিবোধ, সংযম ও দূরদর্শিতার অপূর্ব মেলবন্ধন ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। একজন পরিণত নেতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে। বিবিসি সাংবাদিকের প্রশ্নগুলোও ছিল বাংলাদেশের জনগণের ভাবনার সমান্তরাল। অর্থাৎ মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, মোটামুটি সেগুলোই জিজ্ঞাসিত হয়েছেন তারেক প্রশংসারহমান। তাঁর উত্তরের মধ্যে না ছিল আমিত্বের বড়াই, না ছিল অন্য কোনো পক্ষকে ছোট করার প্রবণতা। সবচেয়ে বেশি ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের প্রতি সম্মানবোধ, বাংলাদেশে যে দুটো জিনিসের অভাব সবচেয়ে বেশি।

আমাদের রাজনৈতিক সমাজে খুব চেনা একটা কালচার এই যে জনগণের কথা বলা হয় নিজেদের বা নিজেকে বৃহৎ করে দেখানোর উদ্দেশ্যে। জনগণের অন্য আরেকটি অংশকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। এই শ্রেণির নেতারাই জনগণের যাবতীয় অর্জন অবলীলায় তুলে নেন নিজের গোলায়। একবার কেউবা কোনো একটি দল জনপ্রিয়তা পেলে মনে করে, এই জনপ্রিয়তা গ্যারান্টেড। জনগণ যেন বা তাদের বাঁধা দাস হয়ে গেছে। একবার সাপোর্ট যখন দিয়েছে তখন (সাপোর্ট) দিয়ে যেতেই হবে সারা জীবন। এবং জনগণ যা অর্জন করেছে তা আসলে ওই দল ও দলের নেতা বা নেতাদের অর্জন। অতঃপর জনগণ ও জনগণের অন্য সব দল ও শ্রেণি মিলে জিরো। আমি বা আমরাই কেবল হিরো।
এরকম বিপজ্জনক রাজনৈতিক মনের পরিচয়, বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে আমরা দুবার পেয়েছি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর খুব নগ্নভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের সব কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ এককভাবে হরণ করেছিল। এটাকে হরণই বলা উচিত। এমনকি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে দলটির বিশেষ কোনো ভূমিকা না থাকলেও অসত্য ইতিহাস জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানও আওয়ামী লীগের একক অর্জন ছিল না। শহীদ আসাদ আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ সেই সময়ের সব রাজনৈতিক দল সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনকি যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান হয়েছিল সেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে মুসলিম লীগপন্থি এনএসএফেরও একাংশের প্রতিনিধিত্বও ছিল। নাজিম কামরান চৌধুরী ছিলেন সেই অংশের নেতা। অন্যকে কৃতিত্ব দিতে আওয়ামী লীগ পূর্বাপর প্রদর্শন করেছে সংকীর্ণতার পরাকাষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সব কৃতিত্ব কুক্ষিগত করে নেয়।

অন্যান্য দলের অবদান তারা ভুল করেও স্বীকার করেনি। প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টারাও হারিয়ে গেলেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে। এমনকি আওয়ামী লীগের ভিতরে যারা সামান্য সমালোচনা করেছেন, তাদেরও সহ্য করা হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উপেক্ষিত হয়েছিল। পরিণতি কী হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়।

বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থান তুলনীয় না হলেও কৃতিত্ব বগলদাবা করার অগণতান্ত্রিক মানসিকতার মধ্যকার মিলটা বেশ লক্ষ করার মতো। জনগণের সংগ্রাম বলি আর জনযুদ্ধই বলি-তার বিজয় কখনোই চট করে এসে যায় না। এটা  দেশলাইয়ের কাঠি খোঁচা দিয়ে আগুন লাগানোর মতো কোনো ব্যাপার নয়। প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকে দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল ৯ বছরের সংগ্রাম। চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানও ৩৬ দিনের অর্জন নয়। এটা কোনো মাস্টারমাইন্ডের ম্যাজিক নয়। এর পেছনে ছিল কমপক্ষে এক যুগের সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস। গুম, খুন, অত্যাচার ও নিগ্রহের ইতিহাস। তারই শেষ প্যারাগ্রাফ বা উপসংহার রচিত হলো আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। আর এই বিক্ষুব্ধকালে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ, নারী ও পুরুষ। প্রায় সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ। শিল্পী, কবি, লেখক, সাংবাদিক সবাই। এ কথাটা তারেক রহমানও বলেছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে।

তার আগে যুগব্যাপী ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল অভ্যুত্থানের পাটাতন। আর সেই পাটাতন তৈরির বছরগুলোতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভূমিকা, তাদের নেতা-কর্মীদের ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সবার সব অবদান ভুলে গিয়ে সব কৃতিত্ব নিজেদের পকেটে ক্যাশইন করলেন। ক্যাশআউট করতে ক্ষমতার হিস্সা বুঝে নিলেন। দল গঠন করে কিংস পার্টির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সরকার, আদালত, সেনাবাহিনী, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ-সবকিছু হয়ে গেল তাদের চোখে অতি ক্ষুদ্র। যেন তারা একেকজন গালিভার হয়ে উঠলেন। হঠাৎ পেয়ে গেলেন দ্য এম্পায়ার অব লিলিপুটের সন্ধান। ছয় ইঞ্চি উচ্চতার মানুষগুলোকে ধরে ধরে পকেটে ভরতে পারেন গালিভার। (জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস দ্রষ্টব্য) তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। অথচ তারা নাকি রাষ্ট্র মেরামত করবেন। সেকেন্ড রিপাবলিক বানাবেন। সেই মেরামতের নমুনা, লোকে বলে, বদলি, পোস্টিং, ঘুষ, চান্দাবাজির ইজারাদার পরিবর্তন। তাদের কেউ কেউ এখন সখেদে বলছেন সেফ এক্সিটের কথা। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই নাকি তারা নিরাপদ নন। মৃত্যুই নাকি হতে পারে তাদের একমাত্র সেফ এক্সিট। একবার কি তারা দয়া করে ভেবে দেখবেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কেন তাদের মনে সেফ এক্সিটের প্রশ্ন উঠছে!

গত বছরের জুলাই ও আগস্টে মানুষ তো তাদের ভালোবেসেছিল। আজ কেন এমন হলো? কেন আজ তাদের কেউ কেউ অনাগত মবকে ভয় পাচ্ছেন? সব মানুষের মিলিত অর্জনকে নিজের করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ঔদ্ধত্যের যে বিষবৃক্ষ জন্মাল, সেটাই কি এখন তাদের ভয় দেখাচ্ছে?

ইতিহাস শিক্ষা দেয়, সবার সব অবদান উপেক্ষা করে নিজেদের অতি বড় বলে জাহির করার ফল ভালো হয় না। এই জায়গাটায় তারেক রহমান তাঁর দেওয়া ইন্টারভিউতে যে সংযম, বিনয় ও বাস্তব দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার প্রশংসা করা না হলে বড় বেশি কৃপণতা হয়ে যাবে। অনেকের জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে শিক্ষণীয়। সোনা পুড়ে খাঁটি হয়। মানুষ খাঁটি হয় ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই তারেক রহমান যে দহনযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ১৭টি বছর অতিবাহিত করেছেন সেটাই হয়তো তাঁকে বৈদগ্ধ দান করেছে।

বিবিসির সাক্ষাৎকারে আমরা তারই বাচনিক প্রকাশ দেখেছি। কিন্তু বাণী-বচনই শেষ কথা নয়। কর্মেও তার প্রমাণ থাকতে হবে। ২০০৮ সালে যারা দিনবদলের ইশতেহার দিয়েছিল, যারা সাচ্চা গণতন্ত্রের কথা বলেছিল, যারা অঙ্গীকার করেছিল বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য তারাই তীক্ষè নখর-দন্তের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে মনুষ্যত্ব। হরণ করা হয়েছিল মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। তারা প্রমাণ করেছিল, যে-ই লঙ্কায় (ক্ষমতা অর্থে) যায়, সে-ই রাক্ষস হয়। এটি লোকবচন। লোকবচন কোনো ধ্রুব সত্য নয়। লঙ্কায় গিয়ে রাক্ষস না হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে।

জনগণ চাইলে, ম্যান্ডেট দিলে বিএনপি অদূরভবিষ্যতে সরকারে যেতে পারে। তখনই বোঝা যাবে, কথা ও কাজে মিল কতখানি! পার্টির লিডার হিসেবে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্টেটসম্যান হিসেবে জনাব রহমান ও তাঁর দলকে কাজের মধ্য দিয়ে অতীতে যেসব বদনাম ছড়ানো হয়েছে, তার জবাব দিতে হবে। সেভাবে দলকে প্রস্তুত করতে হবে। বিএনপির মধ্যে নানান স্তরে অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছেন, যারা মেধাবী, প্রজ্ঞাবান, সুশিক্ষিত এবং সুচেতনার ধারক। এই শ্রেণির নেতা-কর্মীকে সামনে আনতে হবে।

চান্দাবাজ, ধান্ধাবাজ শ্রেণিটিকে দলে নিষ্ক্রিয় করতে হবে। তা না হলে এরা ইলেকশনে দলের ক্ষতির কারণ হবে। এরা লোকের কাছে ভোট চাইতে গেলে ক্ষেত্র বিশেষে উল্টো ফল হতে পারে। স্থানীয় লোকজন এদের হাড়ে হাড়ে চেনে। এদের লোকে ভয় পায় কিন্তু সমীহ করে না। ভোটের বাক্স ছিনতাই করতে, জাল ভোট করতে এদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফ্রি ফেয়ার ভোটের মাঠে এদের কোনো মূল্য নেই। কাজেই দলের কর্মী-সমর্থক বলে এদের মাথায় আহ্লাদের ছায়া দেওয়ার কোনো দরকার নেই। দুষ্ট গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভালো।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।