ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

অগোছালো অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বেহাল দশা

পলিটিক্যাল ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩১ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৭
অগোছালো অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বেহাল দশা বিএনপির লোগো

ঢাকা: মূল দলের মতোই বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেহাল ও অগোছালো অবস্থা। যে ছাত্রদল ও যুবদল বিএনপির প্রাণ বলে পরিচিত, আন্দোলন-সংগ্রামে-মাঠে-ময়দানে তাদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যত নেতা-পাতি নেতার ডিজিটাল ও সচিত্র পোস্টার ঝুলছে, তত নেতাকে একত্রে ও একসঙ্গে দেখা যায় না। কয়েকজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। সেখানে পছন্দের লোক আর কোটারি তৈরি হয়েছে। দলকে সমৃদ্ধ করতে নতুন রক্ত-সঞ্চালন বা নতুন নতুন নেতা-কর্মীর বিকাশ ঘটানোর কোনোই তৎপরতা নেই। অনেক নেতাই বয়সের ভারে ন্যূব্জ। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও ফিডব্যাক পাচ্ছে না বিএনপি।

আগের কিস্তি পড়ুন
** দিশেহারা বিএনপি-৬: নেতা বহু সংগঠক নেই, রুটিনে আবদ্ধ মহাসচিব​
** দিশেহারা বিএনপি-৫: সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া
** দিশেহারা বিএনপি-৪: কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন
** দিশেহারা বিএনপি-৩: নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য
** দিশেহারা বিএনপি-২ : দুর্নীতি-সুবিধাবাদে গ্রাস নেতৃত্ব
** 
দিশেহারা বিএনপি-১: দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প
বিএনপির বিগত দিনগুলোর তৎপরতার ফিরিস্তি ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরের পর বছর পর্যন্ত কমিটি করতে পারেনি বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এতে স্বভাবতই মনে হবে, নেতৃত্ব বিকাশের পথটি যেন ইচ্ছা করেই রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

দেশের আশি ভাগ স্থানে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি। কোথাও কোন্দলে, কোথায় নেতাদের দড়ি টানাটানিতে, কোথায় টাকার লেনদেনের কারণে আটকে আছে কমিটি। এতে দলের সর্বস্তরে সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন অচলাবস্থা।  

কোনো ধরনের দলীয় স্বীকৃতি না-পাওয়ায় হতাশ হয়ে গেছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তাই অনেকেই এখন দলবিমুখ। কেউ কেউ নিজেরাই নিজেদের মতো ফ্রি-স্টাইলে দল চালাচ্ছে। বিশেষ করে তৃণমূল ও মফঃস্বল পর্যায়ে চলছে এমন বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা। সেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপ-দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন কার্যক্রমেই আবর্তিত হচ্ছে বিএনপির রাজনীতি। কখনও অন্তঃকোন্দল, কখনও বিরোধ-কলহ তীব্র হচ্ছে। জমছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ। বিগত আন্দোলনকালে এক গ্রুপের কেউ আটক হলে অন্যরা মনে মনে খুশি হয়েছে। এমন হয়েছে যে, ‘ক’ নামের কোনো নেতা আটক হলে তাকে মুক্তি করা দূরে থাকুক, ‘খ’ বা ‘গ’ কেন আটক হয়নি, সেটা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে ‘খ’ এবং ‘গ’ সরকারের দালাল। দলে কে কার দালাল বা দালাল নয়, যেন সেই পরীক্ষা শুরু হয়।

বিএনপির প্রযত্নে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক বিকাশ ও গোছানোর অভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নাম-সর্বস্ব ও প্যাডধারী সংগঠন। আজ এই নেতাকে তো কাল অন্য নেতাকে সামনে নিয়ে প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক ও পত্রিকার পাতানির্ভর কর্মসূচিতেই ব্যস্ত এসব সংগঠন। এসব ভুইফোড় সংগঠনের এক বা দু’জন নেতার কাজ অনুষ্ঠান করার নামে চাঁদাবাজি করা। কয়েকজন কথিত বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক এসব সংগঠনের নেপথ্য মদদদাতা। তৃণমূল বা ব্যাপক কর্মী-সমর্থক-জনগণের সঙ্গে এদের যোগসূত্র নেই বললেই চলে।

অঙ্গ-সংগঠনের ক্ষেত্রে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধ ওপেন সিক্রেট। ছাত্রদল, যুবদল, মহিলা দল, তাঁতীদল, কৃষকদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ইত্যাদি সংগঠনে নেতৃত্বের কোন্দল চরমে। কোথাও সভাপতি কমিটি করলে সাধারণ সম্পাদক বাগড়া দিচ্ছেন; কোথায় সাধারণ সম্পাদকের কাজকে আটকে দিচ্ছেন সভাপতি। মূল দলের মতোই অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে নিয়মিত সাংগঠনিক সভা-মিটিং, কাউন্সিল, সম্মেলন নেই বললেই চলে। নতুন নেতৃত্বকে পথ করে দেওয়ার রাস্তাও বন্ধ। অনেক কেন্দ্রীয় নেতা কমিটিতে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের লোক হিসেবে নাম লিখিয়ে আদুভাই হয়ে আছেন। তাদের একমাত্র কাজ নেতার পক্ষে লবিং-গ্রুপিং করা, দলের কাজ করা নয়।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রদলের একজন নেতার বক্তব্য এমন, ‘বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের পদ-পদবিগুলো এখন চাঁদার বাক্স হয়ে গেছে। একজন কোনোভাবে একবার কোনো কমিটির কোথাও জায়গা পেলে সেটাকে ভাঙিয়ে দিব্যি চলছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নয় এবং ক্যাম্পাসেই আসে না, এমন কয়েকজনকে দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। দশ বছরেও সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সবাই আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটায় কেন্দ্রীয় নেতা। ছাত্রদল এখন নোমান, আমীর খসরু, আসলাম চৌধুরী, এসএম ফজলুল হক গ্রুপ হয়ে কাজ করে। ছাত্রদলের ঐক্যবদ্ধ কাজ বলতে গেলে কোথাও নেই। ’

এমন অবস্থা প্রায়-সর্বত্র। কিশোরগঞ্জে কমিটি করতে গিয়ে বিভিন্ন উপদলের আক্রমণ ও সংঘর্ষে জিম্মি হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পরে কোনো মতে পালিয়ে আসেন তারা। দলের সর্বব্যাপী কোন্দল মেটানোর উপায় খুঁজে বের করার উদ্যোগ না থাকায় অন্তঃদ্বন্দ্ব দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে।

মহিলা দলের এক বর্ষিয়ান নেত্রী চট্টগ্রামের মানুষ হলেও সার্বক্ষণিক কেন্দ্রে থেকে কাজ করেন। কিন্তু তার সঙ্গে ঢাকার তরুণদের স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে। বিএনপির মহিলা নেতা-কর্মীদের মধ্যে শিরিন গ্রুপ ও হেলেন গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য বিষয়। হেলেন জেরিন খান বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে আপোসহীন ও সংগ্রামী ভূমিকা রাখলেও এখন দলে কোণঠাসা হয়ে আছেন। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারছেন না মাদারীপুরভিত্তিক একটি গ্রুপের এই নেত্রী।

দলের মধ্যে এখনও জিইয়ে রাখা হয়েছে সংস্কারপন্থি ইস্যু। কাউকে পেছনে ফেলতে হলে তাকে সংস্কারপন্থি বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দলে জেলাভিত্তিক উপদলও বেশ চাঙ্গা। নোয়াখালী বা বরিশাল গ্রুপ কখনও কখনও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে।

বিএনপির সাংগঠনিক বৈকল্যের কুপ্রভাব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতেও ব্যাপকভাবে পড়েছে। মূল দলের সাংগঠনিক স্থবিরতা ও কোন্দল বিস্তারিত হয়েছে অঙ্গ ও সহযোগী দলগুলোতে। কমিটি ও কাউন্সিল না থাকায় যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। ভুইফোড়রা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরই সঙ্গে অমুক নেতার লোক বা অমুক এলাকার লোক হিসাবে নানা সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে অনেক ধুরন্ধররা। দলের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও চেইন অব কমান্ড আনার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা, সেটা আন্দোলনের মাঠে বিএনপিকে বারবার ব্যর্থতাই উপহার দিচ্ছে। চেয়ারপারসন খালেদার জিয়ার চারপাশে ভিড় করে থাকলেও দলের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম বা সাংগঠনিক শক্তি বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারছে না অনেকেই। ১/১১-এর পর থেকে যে স্থবিরতার চোরাবালিতে আটকে আছে সাংগঠনিক কার্যক্রম, সেটা দূর করা না হলে দলের গতিশীলতা ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনীতি অধরাই থেকে যাবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

পরের কিস্তি পড়ুন: দিশেহারা বিএনপি-৮: এখনও মশগুল অতি-আত্মবিশ্বাসের তৃপ্তিতে

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৭

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।