কক্সবাজার থেকে ফিরে: চকচকে পলিব্যাগে মোড়ানো ছুরি, লইট্টাসহ বিভিন্ন শুঁটকি ঝুলছে থরে থরে। দোকানে বেশ ভিড়।
এ বছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই তপ্ত প্রকৃতিতে মিলছে শীতের আমেজ। এর মধ্যে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এর প্রভাবেও অনেকটা শীতল হয়েছিল উষ্ণ প্রকৃতি। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে শীত নেমেছে প্রকৃতিতে। তাই এখন আর গরমের তেজ নেই। পুরোদস্তুর শীতে বাংলার প্রকৃতিতে বিরাজ করছে স্থির, মায়াবী এক মোহনীয় আবহাওয়া। আর পৌষের এমন ফুরফুরে শীতল আবহাওয়ায় প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানোর মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। তাই দুয়ার খুলেছে পর্যটন শিল্পের। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক যাচ্ছেন দেশের প্রধান পর্যটন নগর কক্সবাজারে।
আর এজন্য পর্যটকদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠেছে ৯৬২ দশমিক ১১ বর্গমাইল আয়োতনের এই পর্যটন শহর। চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে থাকা এই কক্সবাজার জেলা বিশ্বে পরিচিত তার অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যেরই জন্যই। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমিকে অলঙ্কৃত করেছে এখানকার ১২০ কিলোমিটারের বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত। কেবল পর্যটন কেন্দ্রই নয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে থাকা এই শহরেই রয়েছে বিশাল মৎস্য বন্দরও।
বছর ঘুরে সেখানে আবারও শুরু হয়েছে পর্যটন মৌসুম। আর পর্যটকের সমাগম বাড়ায় বেড়েছে শুঁটকি মাছের চাহিদাও। কারণ এই শুঁটকি মাছের জন্যও প্রসিদ্ধ এই পর্যটন শহর। কক্সবাজারে বেড়াতে যাবেন আর শুঁটকি কিনবেন না? এই কথা শুনতেও যেন বেমানান লাগে অনেকের কাছে। নিজে পছন্দ না করলেও পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদেরর জন্য শুঁটকি মাছ যেন কিনতেই হয়। কারণ কক্সবাজার ভ্রমণে যাচ্ছেন শুনলে সবাই বলে দেয়, যেন ফেরার সময় শুঁটকি মাছ নিয়ে আসেন। আর শুঁটকি মাছপ্রেমী মানুষ হলে তো কথাই নেই।
আমের মৌসুমে পর্যটন শহর রাজশাহী গেলে যেমন রেশমি শাড়ি ও পাঞ্জাবী কিনতেই হবে তেমনিভাবে পর্যটন মৌসুমে সমুদ্র বিলাসে কক্সবাজার গেলে শুঁটকি মাছ কিনতেই হবে। কেনাকাটার এই প্রথা ও পরম্পরা যেন একে অপরের সাথে একই সুঁতোয় গাথা। এজন্য পর্যটন মৌসুমে এই কক্সবাজারে পর্যটকদের কেনাকাটার তালিকার শীর্ষেই থাকে সুস্বাদু শুঁটকি মাছ। লবণ-বিষ ও কেমিক্যালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু এই শুঁটকি মাছের চাহিদা এখন দিন দিন বাড়ছে।
শুঁটকি মাছ বৈচিত্র্যময় একটি লোভনীয় বাঙালি খাবার। এক শুঁটকি মাছ দিয়ে তৈরি করা যায় হরেক স্বাদ ও নামের জনপ্রিয় সব খাবার। একেক জন ভোজনরসিক একেকভাবে পাতে শুঁটকি মাছ রাখতে পছন্দ করেন। তাই এটি যে গৃহিণীদের রান্না ও রসনায় এক অনন্য পদ তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আর দেশের বাজারের গণ্ডি পেরিয়ে শুঁটকির চাহিদা এখন বিশ্ব বাজারেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাই প্রতি বছরের এই শীতে পর্যটন মৌসুমকে ঘিরে কক্সবাজারে জমজমাট হয়ে ওঠে শুঁটকির ব্যবসা। এবারও পর্যটন মৌসুম ঘিরে কক্সবাজারের শুঁটকির দোকানগুলো সেজেছে বিশেষ সাজে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেছেন নানান প্রজাতির শুঁটকি।
বাংলাদেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক শুঁটকির সবচেয়ে বড় অংশ তৈরি হয় কক্সবাজারে। কক্সবাজারের নাজিরাটেক এলাকাকে দেশের শুঁটকি উৎপাদনের বৃহত্তম কেন্দ্রস্থল তথা শুঁটকির গ্রাম বলে বিবেচনা করা হয়। কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেসে প্রায় একশ একর বালুচরজুড়ে গড়ে উঠেছে নাজিরাটেকের শুঁটকি মহাল।
দেশে উৎপাদিত শুঁটকির প্রায় ৮০ শতাংশ এই নাজিরাটেকেই পাওয়া যায়। শুঁটকি ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, প্রতি মৌসুমে বিশেষ করে শীতের শুরুতে শুধুমাত্র নাজিরাটেক শুঁটকি মহলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। কক্সবাজারের বাজার ঘাটা এলাকার বড় বাজারে রয়েছে সবচেয়ে বৃহৎ শুঁটকি মার্কেট।
আর এই বড় বাজারে ঢুলে যে কারোরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। কারণ শুঁটকি বাজার তো নয় এ যে এক শুঁটকির রাজ্য। হয়ত এক সাথে এত জাত ও পদের শুঁটকি মাছের দেখা পাওয়া যাবে না দেশের আর অন্য কোথাও। কোনটা রেখে কোনটা কিনবেন এমন চিন্তার সাগরে ডুবে যেতে হবে অনেককেই! বড় বাজারের মাছপট্টি ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শুঁটকি বাজারের অর্ধশতাধিক দোকান রয়েছে শুঁটকির।
এই মার্কেটে দৈনিক ৬০-৭০ লাখ টাকার শুঁটকি মাছ কেনাবেচা হয়। এছাড়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ বার্মিজ মার্কেটের অভিজাত দোকান, হোটেল-মোটেল জোন, লাবণী বিচ মার্কেট, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলীসহ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা যায় সুদৃশ্য পরিপাটি শুঁটকি মাছের দোকান। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা বেড়াতে গিয়ে এসব দোকান থেকে শুঁটকি মাছ সংগ্রহ করেন অনেকটা নিশ্চিন্তেই।
বড় বাজারের শুঁটকি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, ফাইস্যা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, ছুরি ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, ছোট পোয়া ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, রইস্যা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, মাইট্যা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, বড় চিংড়ি ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা, মলা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, কাঁচকি ৫০০ থেকে ৭০০ করে, সুরমা ৭৫০ টাকা, চেপা পুটি ও বাঁচপাতা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি করে।
শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে লাক্ষা ও রূপচাঁদা মাছের শুঁটকি। বর্তমানে এক কেজি রূপচাঁদা শুঁটকি ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা ও লাক্ষা ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি কোরাল ১৩০০, রূপচান্দা ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা, টুনা ১৪০০ টাকা, বোয়াল ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, শুঁটকি মাছের বাজারগুলোতে প্রায় সারাদিন ক্রেতাদের ভিড় থাকে। তবে সকালে, বিকেল ও সন্ধ্যায় নামে পর্যটকদের ঢল। স্থানীয়রা এখানে কেনাকাটা করলেও পর্যটকরাই এই শুঁটকি বাজারের মূল ক্রেতা। পর্যটকদের নজর কাড়তে এখানে চকচকে পলিথিনে মুড়িয়ে নানানভাবে থরে থরে সাজানো থাকে নানান জাতের শুঁটকি মাছ।
তাই দোকানে সারি সারি সাজানো শুঁটকি এখন ক্রেতাদের নজর কাড়ছে। পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করতে এখন আরি আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে শুঁটকির দোকানগুলোকে। পর্যটকরা কেবল চট্টগ্রামের এই কক্সবাজার শহর থেকেই দৈনিক প্রায় কোটি টাকার শুঁটকি কিনছেন বলে জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজারের বড় বাজার মার্কেটে শুঁটকির জন্য সুপরিচিত ব্যবসায়ীর নাম বশির সওদাগর। তার নাম বশির আহমেদ হলেও সবাই তাকে ওই নামেই চেনেন। কথা হতেই তিনি বলেন, আমাদের দোকানে প্রায় ৪০ জাত ও স্বাদের শুঁটকি আছে। এর মধ্যে ছুরি, লইট্যা, চান্দা, কোরাল, মাইট্যা শুঁটকির চাহিদা বেশি। আর এখন বিক্রি ভালোই হচ্ছে। পর্যটকদের কাছে শুঁটকির চাহিদাও বেড়েছে। কক্সবাজারের শুঁটকির মান দিন দিন ভালো হচ্ছে। এখন আর বিষ দিয়ে কোথাও শুঁটকি শুকানো হয় না। বিশেষ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ রোদে দিয়ে শুকানো হয়।
আরেক ব্যবসায়ী মো. আলমগীর বলেন, পর্যটন মৌসুমে আমাদের ব্যবসা ভালো হয়। দামের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪ হাজার টাকার দামের শুঁটকি রয়েছে। পর্যটন মৌসুমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেও শুঁটকির দাম বেড়েছে। বিষমুক্ত শুঁটকি ক্রেতাদের তুলে দিতে পারলে আমাদের কাছেও ভালো লাগে।
কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া শুঁটকি আড়ত দোকানের মালিক মো. ছলিমুল্লাহ বলেন, মাছ ভালোভাবে শুকিয়ে পলিথিনের প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়। ফলে শুঁটকি মান ভালো থাকে এবং সহজে নষ্ট হয় না। এতে পর্যটকরা সন্তুষ্ট হয়ে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করেও কুরিয়ারে পাঠানোর জন্য অর্ডার করে। আমরা কম লাভে শুঁটকি বিক্রি করি বলে সারাদেশেই ক্রেতাদের চাহিদা রয়েছে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসছেন, যারা বিদেশে তাদের আত্মীয় স্বজনের জন্য শুঁটকি নিয়ে যাচ্ছে। মূলত এখন শুঁটকির মান ভালো হয়েছে তাই চাহিদাও বেড়েছে। বড় বাজার শুঁটকি মার্কেটের দোকানগুলোতে পর্যটন মৌসুমে দৈনিক ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকারও বেশি শুঁটকি মাছ বিক্রি করা হচ্ছে।
শুঁটকি মার্কেটে আসা ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা মো. হারুন-উর-রশিদ বলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে আসার আগে অনেকে শুঁটকি নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। তাই শুঁটকি কিনতে এসেছেন। তিনি রূপচাঁদা শুঁটকি কিনেছেন তিন হাজার টাকার।
জামালপুর থেকে আসা পর্যটক রিয়াসাত আলম বলেন, পরিবারের সবাই শুঁটকি মাছ ভীষণ পছন্দ করেন। আর কক্সবাজারের শুঁটকি এলেই খুব সুস্বাদু। যতবারই কক্সবাজারে আসেন ততবারই এখান থেকে শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। এবার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়ার জন্য পাঁচ কেজি লইট্টা ও তিন কেজি ছুরি শুঁটকি কিনেছেন বলে জানান।
আরও পড়ুন>>
যেভাবে ‘পালঙ্কী’ থেকে নাম বদলে ‘কক্সবাজার’
প্রকৃতিতে হেমন্তের পরশ, সাগরে ছুটছেন পর্যটকরা
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২৩
এসএস/এএটি