জীবনানন্দের ‘এখানে আকাশ নীল’র সবটুকু নীল তখন আমাদের মাথার উপরে। সেই নীল সায়রে পেজোতুলোর মেঘের ওড়াওড়ি।
সেদিন ছিল ২১ সেপ্টেম্বর। যেদিন দীর্ঘদিনের ‘সংলাপ’ শেষে আমরা দলবেঁধে দেখতে গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জে ঐতিহ্য ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইন, করিমগঞ্জের দিগন্ত বিস্তৃত হাওর। অনেক দিন ধরেই শখ হাওর দেখার। জল টইটম্বুর হাওরে ডিঙি নৌকা হাঁকিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরছে গেরস্থরা। হাঁটুরে লোকজন ফিরছে ইঞ্চিনচালিত ট্রলারে। হাওরের দ্বীপসদৃশ ছোট্ট বাড়ির উঠোনে মাথায় ঘোমটা টেনে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ কোনো নারী- অপেক্ষায় সন্তান বা স্বামীর। মাথার উপর সুনীল আকাশে লুকোচুরি মেঘ আর রৌদ্রের। হাওরেরই একপাশের জলরাশিতে টুপ করে ডুবে যাচ্ছে রক্তিম সূর্য।
হাওর দেখার পরিকল্পনার পর থেকেই এসব চিত্রপট মনে মনে এঁকেছি। অবশেষে এলো সেই ক্ষণ। শুরুতে বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী ডজনখানেক সাড়া দিলেও হাওরের পথে যেদিন রওয়ানা হলাম, সাকুল্যে তখন কাফেলায় আমার সঙ্গে সাবেক চার সহকর্মী সজিব, রিমন, মিঠু এবং আজাদ।
আগেই সব আয়োজন স্থির করা ছিল। ভোরেই সবাই চলে এলাম মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে অনন্যা পরিবহনের বাস যখন আমাদের পাকুন্দিয়ার থানাঘাট নামিয়ে দিলো, তখন ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে গেছে। কাছাকাছি কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘুরে মঠখোলা বাজার থেকে সোজা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে রওয়ানা দিলাম কিশোরগঞ্জ সদরে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সাবেক সহকর্মী টিটু দাস। কিশোরগঞ্জ সদর থেকে অটোরিকশায় করে যখন করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম, তখন বিকেল ৪টা। টিটু দাসই ফোনে ফোনে সব ঠিক করে দিলেন। ঘণ্টাখানেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম চামড়া বন্দর। করিমগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত এ ঘাট থেকেই প্রতি মুহূর্তে ট্রলার ও নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও কুলিয়ারচরের উদ্দেশ্যে। কয়েকটি উপজেলা নিয়ে তৈরি এই বিশালাকার হাওর একনজর দেখেই মুগ্ধ হলাম আমরা। ওপরে সুনীল আকাশ, নিজে স্বচ্ছ জলের খেলা। যতদূর চোখ যায় জল কেবল জলতরঙ্গ ঝিলিমিলি।
টিটু দাসই ঠিক করে রেখেছিলেন শাহ আলম নামে এক মাঝির ট্রলার। অনায়াসেই ট্রলারের ভেতরে ও ছাদে ৩০/৪০ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারেন; তবে আমরা যাত্রী মাত্র পাঁচজন। ট্রলারে উঠেই লক্ষ্য করলাম ঘাটের অনেকেই ড্যাব ড্যাব করে আমাদের দেখছেন। এতোবড় ট্রলারে মাত্র পাঁচজন, দর্শকের এমন অভিব্যক্তি ভাবতেই বেশ বিব্রত হতে হলো।
চলতে শুরু করলো ট্রলার। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সবাই ঘেমে-নেয়ে আর ধুলোবালিতে কাহিল। কিন্তু হাওরের হেমন্তের বাতাস গায়ে লাগতেই টনিকের মত কাজ করলো। হাওরে রোদের তেজ তখনো কমেনি।
ফলে ট্রলারের নিচতলাতে; ভেতরে জমে উঠলো আড্ডা। তবে সেটা মিনিট দশেক। উঠে এলাম ট্রলারের ছাদে। সারি বাঁধা চেয়ার ও গলুইতে বসলাম আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আড্ডা, গানের পাশাপাশি চললো সবার মোবাইল ফোনে ভিডিওচিত্র ধারণ ও ছবি তোলা। কোনো দৃশ্য যেন মিস না হয় চললো তার জোর প্রচেষ্টা। শাহআলম ভাই জানতে চাইলেন, কোথায় যেতে চাই? বললাম, হোথায়। সেটা কোথায়, না শাহআলম ভাই না আমরা কেউই ঠাওর করতে পারলাম না। আমরা তখন ব্যস্ত হাওর রানির সৌন্দর্য অবলোকনে। শাহআলম ভাই নিজের মতো করে চলতে লাগলেন। ক্রমেই আমরা পেরিয়ে গেলাম শ্যালোইঞ্জিনের পাকা ঘর, বিদ্যুতের খুঁটি। কোনো জমির সীমানা নির্দেশক পিলার। ইটভাটার চিমনি। তবে ভাটার অবয়ব অদৃশ্য; সব পানির রাজ্যে নিমজ্জিত।
শুকনো মৌসুমে একফোটা জলহীন বিশাল আদিগন্ত সবুজ তৃণভূমি এই বর্ষায় অকূল দরিয়া হয়ে উঠেছে- ভাবতেই কেমন শিহরণ বয়ে যায় মনে। ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎই খেয়াল হলো সামান্য দূরে ছোট্ট সবুজ চর। ক্রমেই ট্রলার সেদিকে যাচ্ছিল। চরের কূলে ভিড়তেই আরও একবার বিষম খেলাম আমরা। এই জনমানবহীন দরিয়ার মাঝে এমন পটে আঁকা সৌন্দর্যময় তৃণদ্বীপ- আমরা কল্পনাতেই আনতে পারিনি। মুহূর্তেই আমরা ওই তৃণভূমির নাম দিয়ে দিলাম ‘নিউজিল্যান্ড’।
তো ট্রলার ভিড়িয়ে লাফিয়ে নামলাম সেই চরে। অনেকটা গোলাকার চর, আকারে বড় একটা ক্রিকেট মাঠের সমান। তারই এককোণে পানির ভেতরে ও মাঝামাঝি কয়েকটি প্রায় ন্যাড়া গাছ চরটিকে দিয়েছে অনন্যতা। ২৫-৩০টি গরুর পাল চড়ছিল এখানে। যা তৃণভূমিকে করে তুলেছে অপূর্ব। সেখানে আমরা হাত পা ছড়িয়ে বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে নানান আঙ্গিকে ছবি তুললাম। ততক্ষণে সূর্য সোনারঙ হারিয়ে লাল হতে শুরু করেছে।
ফিরলাম ট্রলারে। মাথার ওপর নীলের রাজ্য আর পায়ের নিচে নীলাভ দরিয়ার মুগ্ধতাও আমাদের নাড়িয়ে দিল। ছবি ও ভিডিওধারণ করতে গিয়ে দলের সবারই আক্ষেপ, আগেভাগেই কেন মোবাইল ফোনের চার্জ ফুরিয়ে এলাম। মাঝি আমাদের এই উচ্ছলতাকে কিছুটা পাগলামো ভাবছেন তা বোঝা গেল সহজেই। তিনিই জানালেন, হাওরের ভেতরেই একটা বাজারে নিয়ে যাবেন। ট্রলার চললো সোজা। ক্রমেই পেরিয়ে গেলাম দূরে দূরে থাকা কল্পনায় দেখা সেসব সবুজাচ্ছাদিত দ্বীপসদৃশ বাড়ি। চারপাশে জলের মধ্যে ছিমছাম গেরস্থ বাড়ি। বাড়ি লাগোয়া সবজি ক্ষেত, শিশুদের খেলার মাঠ। খড়ের স্তূপ, গরুর পাল। আর দশটা গ্রামের বাড়ির মতোই। তবে চারপাশে শুধু পানি আর পানি।
মাঝিই জানালেন, হাওরে মেশা ধনু নদীর মোহনা পার হচ্ছি আমরা। হাওর আর ধনু নদী মিলেমিশে একাকার হওয়া মোহনা পার হয়ে ট্রলার গিয়ে থামলো বালিকলা বাজারে। সেটাও একটা ছোট্ট দ্বীপ। পাশেই ড্রেজিং জাহাজ নোঙর করা। পুরো দ্বীপের এককোনায় কয়েকটা পরিবারের বসতবাড়ি। আর পাশেই নির্মিতব্য অলওয়েদার সড়কের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের দু’টি থাকার ঘর। একটা মুদি দোকান; তাতে স্বল্প পরিমাণে রাখা চা, পান, বিড়ি আর সাবান, বিস্কুটসহ অন্যান্য পণ্য। দোকানের সামনে চৌকিতে অলস সময় কাটাতে তাস খেলায় মগ্ন শ্রমিক ও স্থানীয়রা। এক দোকান আর কয়েকটা পরিবারের এই দ্বীপটাকে যে কি অর্থে বাজার বলা হয় তার মাজেজা বুঝতে পারলাম না কেউই।
বালিকলা বাজারে চা খেয়ে গেলাম পাশেই হাওরবাসীর স্বপ্ন হয়ে ওঠা নির্মিতব্য সড়কে। পুরো কিশোরগঞ্জের হাওরবাসীকে উন্নয়নের মূলস্রোতে শামিল করার লক্ষ্য নিয়ে নির্মিতব্য এ সড়ক নির্মিত হচ্ছে হাওরের বুক চিরে। করিমগঞ্জের নিয়ামতপুর থেকে শুরু হওয়া এ আভুরা সড়ক বালিকলা বাজার পর্যন্ত এসে থেমেছে। স্থানীয়রা জানালেন, এ সড়ক গিয়ে মিলবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংযোগ সড়কের সঙ্গে। ফলে হাওরবাসী যেকোনো সময় দ্রুত হাওর পেরিয়ে গন্তব্যে যেতে পারবেন।
বেড়িবাঁধের মতো উঁচু এ সড়কে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখলাম রাস্তার ওপারের জলরাশিতে সূর্যের অস্ত যাওয়া। কানে এলো মাগরিবের আজান। তাগাদা পেয়ে দ্রুত গিয়ে ট্রলারে উঠলাম। এবার সোজা ফেরার পালা, চামড়া বন্দর। শুল্কতিথির কারণে ততক্ষণে জোছনা উঠেছে। সেই জোসনা আর চাদের অপরূপ সৌন্দর্য এসে আছড়ে পড়ছে হাওরের জলরাশিতে। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। এই জল-জোছনায় কিছুক্ষণ হাওরে ভাসার ইচ্ছা থাকলেও বাধ সাধলেন মাঝি। রাতে হাওরে নিরাপত্তা সংকট রয়েছে জানালেন, ফলে বাধ্য হয়েই দ্রুত ফিরতে হলো ঘাটে। তখন ঘড়িতে প্রায় ৭টা। ঘাটে ফিরলেও তখনো হাওরের মুগ্ধতার রেশ যেন কাটছিল না।
ওদিকে, কিশোরগঞ্জ সদরে অপেক্ষায় থাকা টিটু দাসের বারংবার ফোন। আবারো অটোরিকশা চেপে রাতেই ফিরলাম শহরে। স্মৃতির পাতায় হাওরে হারিয়ে আসা বিকেলকে জমা রেখে; ব্যস্ততা থাকায় ওই রাতেই ফেরা হলো ঢাকায়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী থেকে অনন্যা পরিবহন বা অন্য বাহনে কিশোরগঞ্জ। অনন্যায় ভাড়া ১৭০ টাকা। সেখান থেকে জনপ্রতি ৪০ টাকা অটোরিকশা হিসেবে চামড়াবন্দর। ঘাটে থাকা বেশিরভাগ ট্রলার বিভিন্ন গন্তব্যগামী মানুষজনের জন্য। তবে বেশকিছু ছোট ও মাঝারি মানের ট্রলার রয়েছে পর্যটকদের জন্য। ঘণ্টাপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বা দূরত্বের ওপর ট্রলারের ভাড়া নির্ভর করে।
থাকা-খাওয়া
চামড়াবন্দর বাজারটি বেশ বড়। সেখানে মাঝারি মানের কিছু ভাতের হোটেল ও কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেগুলোতে রাত্রিযাপন করা যায়। তবে দূরত্ব কম হওয়ায় কিশোরগঞ্জ শহরে ফেরাই উত্তম। সেখানে ভালো মানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সরকারি ডাকবাংলো ও রেস্ট হাউস রয়েছে।
লেখক
কবি ও ব্যাংকার
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৮
এইচএ/