বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তের বেনাপোল থেকে কলকাতা কয়েক ঘণ্টার পথ। উত্তরের বাংলাবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি খুব কাছের শহর নয়।
গণমাধ্যমের হাত ধরেই এগোবে বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সম্পর্ক
মনে আছে, শৈশবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেনে আসা-যাওয়ার সময় আখাউড়া স্টেশনে এলে রোমাঞ্চিত হতাম। জানালা দিয়ে পূর্ব দিকে তাকালে কখন আগরতলা দেখা যাবে, সারা পথ এই ভেবে কেটে যেত। কসবা স্টেশনে এলে তো উত্তেজনা চরমে! ট্রেন চলছে দু’দেশের সীমানা বরাবর। একপাশে বাংলাদেশ। অন্য পাশে ভারত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। রাতের বেলা আগরতলা শহরের আলো নিকষ কালো আকাশের অনেকটুকু জায়গা রাঙিয়ে দিত। আহ! কত কাছেই না আগরতলা শহর! চোখে দেখা যায়, তবু যাওয়া যায় না!
আগরতলা নিয়ে কত কথাই না ভেবেছি জীবনের অসংখ্য রেলযাত্রায়। স্বপ্ন দেখেছি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিস্পর্শী শহরের যাওয়ার। অমর সঙ্গীতকার শচীন দেব বর্মন, শিক্ষা ও শিল্পপ্রেমী ত্রিপুরার রাজা মাণিক্য কিশোরের হাতে-গড়া আগরতলায় ঘুরে বেড়ানোর রোমান্টিক কল্পনায় ভেসেছি। ত্রিপুরা আর আগরতলা আমার মনের গভীরতম চেতনায় এতোটাই জায়গা করে নিয়েছিল যে, এ প্রসঙ্গে যৌবনে আস্ত একটি কবিতাই রচনা করেছিলাম । ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আমার সামনে নেই মহুয়ার বন’-এ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সীমান্তগুলো, সীমান্ত শহরগুলো, রেলপথগুলো গৌরবময় ও বৃহত্তর অতীতকে বড় বেশি মনে করিয়ে দেয়। একবার দর্শনায় গিয়ে শরীর ছমছম করে উঠেছিল। গোয়ালন্দ-ফরিদপুর-ঝিনাইদহ হয়ে দর্শনার প্রান্ত সীমায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানির বিশাল কম্পাউন্ডে এসে মনে হয়েছিল, আহ! আমি তো নদীয়ার ভেতরেই চলে এসেছি। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গারো পাহাড়ের পাদদেশে আপ্লুত হয়েছি সবুজে-শ্যামলে। সিলেটে উচ্চাবচ পাহাড় যেন হাতছানিতে ডেকেছে ‘পার্বত্য সাত কন্যা’র দেশে। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে শরীরে এসে লেগেছে প্রতিবেশীর পরশ।
দক্ষিণের রামু, উখিয়া, কক্সবাজার বা টেকনাফে গেলে নজরে এসেছে প্রাচীন রোসাঙ-আরাকান রাজ্যের বিলুপ্ত-প্রায় নানা স্মৃতিগন্ধী বিষয়-আশয়। পৃথিবীকে মনে হয়েছে অনেক বড় আর প্রসারিত। অতীতকে মনে হয়েছে স্বপ্নময়।
অনেক দিন ‘দুটি ত্রিপুরার কথা আমরা জেনেছি। একটি পার্বত্য ত্রিপুরা, ভারতের অংশ। আরেকটি শুধু ত্রিপুরা, পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের অংশ।
স্মৃতি ও অতীতের ত্রিপুরা বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রভাবিত গণমাধ্যম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর হাত ধরে আবার নৈকট্যের নিবিড়তায় আমাদের প্রবলভাবে দোলায়িত করেছে। আমরা জানি, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব ১,৭০০ কিলোমিটার। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রামের দূরত্ব মাত্র ১৪০ কিলোমিটার। স্থল কাস্টমস স্টেশনের মধ্য দিয়ে ঐ দুটি শহর থেকে ত্রিপুরায় মালপত্র আনা অনেক সুবিধাজনক তো বটেই, লাভজনকও। এই ভৌগলিক নৈকট্যকে কাজে লাগিয়ে পরিবহন খরচ কমিয়ে লাভজনক ব্যবসা করা সম্ভব। পর্যটন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে নিবিড়তাও বাড়ানো খুবই বাস্তব সম্মত। বাংলানিউজ এই সত্যটিকে সবচেয়ে আগে অনুধাবন করেছে।
কারণ, বাংলাদেশ যেমন তিন দিক দিয়ে ভারতবেষ্টিত, ত্রিপুরা রাজ্যটিও তেমনিভাবে তিন দিক দিয়েই বাংলাদেশের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ত্রিপুরার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বাংলাদেশ আর পূর্বভাগে ভারতের অপর দুই রাজ্য আসাম ও মিজোরাম অবস্থিত। আসামের করিমগঞ্জ জেলা ও মিজোরামের আইজল জেলার দ্বারা মাত্র একটি দিক দিয়ে এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত। বাকী তিন দিকে বাংলাদেশের উপস্থিতি ত্রিপুরার সঙ্গে আমাদের ভৌগোলিক লেনদেন সহজ করে। এই সুসম্পর্ক ও মেলামেশার অবারিত সুযোগ প্রকৃতি নির্ধারিত। সুপ্রতিবেশী ত্রিপুরার মাধ্যমে বাংলাদেশ যেমন উপকৃত হতে পারে, ত্রিপুরাবাসীও তেমনিভাবে বন্ধু বাংলাদেশের মাধ্যমে নানা দিক দিয়ে উপকার পেতে পারে।
প্রথাগত কূটনীতির বাইরে ক্রিকেট বা কালচারাল ডিপ্লোমেসির দ্বারা যেমন বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়, বিশ্বায়নের তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মিডিয়া ও গণমাধ্যমের দ্বারাও নৈকট্যের কাজটি সাধিত হয়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ত্রিপুরার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই পথিকৃতের মতো সাধন করেছে।
বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ-সম্পাদক আলমগীর হোসেন দুদেশের তথ্য-যোগাযোগের ভিত্তি স্থাপনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকালে যে কথা বলেছেন, তা একদিন ইতিহাসের অংশ হবে। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, যোগাযোগ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির লালন-পালন ও বিকাশের স্বার্থে বাংলানিউজ ও এর এডিটর ইন চিফ, অগ্রণী সাংবাদিক আলমগীর হোসেনের অবদান ভাবীকাল গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে।
বাস্তবিক অর্থেই দুদেশের মানুষের মেলামেশার পথ মসৃণ করেছে বাংলানিউজ। শুধু ত্রিপুরা নয়, কলকাতা, বোম্বে, বেঙ্গালুর, দিল্লিসহ তাবৎ দক্ষিণ এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের সকল খবর, জীবনযাত্রা, সুবিধা-অসুবিধার নানা খবর ও ফিচার তাৎক্ষণিক প্রকাশ করে বিশ্বায়নের দ্বারকে প্রসারিত করেছেন এই অগ্রসর সম্পাদক। বাংলানিউজের চোখে কলকাতার স্ট্রিটফুড বা বেঙ্গালুরের চিকিৎসার অন্ধিসন্ধি জানা হয়ে যায় পাঠকের। ত্রিপুরার অরণ্য আর পার্বত্য-প্রকৃতিকেও মনে হয় না অচেনা। ঘরে বসেই বাংলানিউজের হাত ধরে যে কেউ এসব জায়গায় চলে যাওয়ার পথনিদের্শ ও প্রণোদনা অতি সহজেই পেয়ে যেতে পারছেন।
আজ এবং আগামীর পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক বাঙালির অবারিত পথচলার দিশা জাগানোর জন্য বাংলানিউজ এবং এর স্বাপ্নিক এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন ইতিহাসের উজ্জ্বল চিহ্ন হয়ে রইলেন। আগরতলা, কলকাতা, বেঙ্গালুর, দিল্লি, দুবাই, দোহা এবং সমগ্র বিশ্বের পথে-প্রান্তরে ছড়ানো সহস্র-কোটি বাংলাভাষি মানুষের তথ্যের নিত্যসঙ্গী হয়েই বাংলানিউজ এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। এখনকার খবর যারা আগামীকাল নয়, এখনই পড়তে ও জানতে চান, বিশ্বায়ন ও তারুণ্যের দীপ্তিতে প্রোজ্জ্বল এসব মানুষের সঙ্কল্প ও স্বপ্নের সারথী হয়ে বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার রূপকার আলমগীর হোসেন বাংলানিউজ-এর ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সচল, সজাগ ও জাগ্রত পাতায় সেই ঐতিহাসিক আল্পনাই এঁকে দিলেন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি, গল্পকার ও গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
আরো পড়ুন
রাজ প্রাসাদ যেখানে জাদুঘর
রুদ্রসাগরের জলপ্রাসাদে
ত্রিপুরার প্রাচীন পিলাকে ময়নামতির প্রতিচ্ছায়া
গোবিন্দের ভুবনেশ্বরীতেই রবি ঠাকুরের রাজর্ষি বিসর্জন
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৭
জেডএম/