ঢাকা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সরকারের সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যথোপযুক্ত নীতি-পদক্ষেপের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সুদৃঢ়। একই সঙ্গে খাত শুধু স্থিতিশীলই থাকে নি, বরং শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পেরেছে।
বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এমনটাই দাবি করেছে।
সোমবার গণমাধ্যমে এই লিখিত মূল্যায়ন পাঠানো হয়েছে। যদিও অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন। একই অভিমত বিশ্বব্যাংক ও আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিচক্ষণ মুদ্রানীতি ও অন্যান্য নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা ও এর সূচকগুলোর উন্নয়নে ব্যাংক নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এ লক্ষ্যে গত পাঁচ বছরে আইন ও বিধি-বিধানে বেশকিছু সংস্কারও করা হয়েছে।
চলমান বৈশ্বিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও বেশকিছু সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম ও উপযুক্ত নীতি-পদক্ষেপের কারণে সার্বিক বিচারে ২০১৩ সালে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাত (শেষ প্রান্তিক বাদে) ইতিবাচক ধারায় ছিল।
অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন এ পরিস্থিতিতেও অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত ‘রেজিলিয়েন্স’ এর পরিচায়ক। তবে, বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে সূচকগুলো বাস্তব কারণেই বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সার্বিক বিচারে ২০১৩ সালের অর্থনীতি স্বস্তিদায়কই ছিল। ২০১৩ সালে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৫.৭৪ শতাংশ, সেখানে গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬.০৩ শতাংশ।
বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থবছরে গত চার অর্থবছরের গড় প্রবৃদ্ধি পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। তবে সমাজে ও রাজনীতিতে শান্তি ফিরে এলে অর্থনীতির সূচকগুলোতে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) ৭ দশমিক ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা হয়তো অর্জন করা যাবে না। তবে চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের চেয়ে কম হবে না।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৬৯ কোটি ডলার; গত অর্থবছরে রেকর্ড ১ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অর্থাৎ গত চার অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে ৪৯ শতাংশের বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা প্রণোদনা ও প্রচারণা এবং টাকার স্থিতিশীল মূল্য (মান) এই সাফল্য ধরে রাখতে অবদান রেখে চলেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথম প্রান্তিকে ১ হাজার ৩ শ কোটি (১৩ বিলিয়ন) ডলার থেকে বেড়ে ডিসেম্বর মাসে দাঁড়িয়েছে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১ হাজার ৮০০ কোটি (১৮ বিলিয়ন) ডলারে। যা এক অভূতপূর্ব মাইলফলক। অর্থাৎ ২০১৩ সালেই রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পেরিয়েছে।
গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৩ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ রিজার্ভ দেশের ছয় মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধের জন্য যথেষ্ট। এই দিকটায় আমরা এখন ভারত, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে এলিট ক্লাবের সদস্য। ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৭৪৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ চার বছরে রিজার্ভ রেড়েছে প্রায় ১৪২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছিল ২২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩৩ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত চার অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৫১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ১২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ধারা ইতিবাচক ধারায় থাকায় আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অপরদিকে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে রেকর্ড ২৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ গত চার অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ১১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, মূল্যস্ফীতিও এখন কমতির দিকেই রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে গড় বার্ষিক ও পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৬২ ও ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, সেখানে গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা অনেকটাই কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭০ ও ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
আর চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে আরো কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫১ ও ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে। এ কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকার ঝুঁকি অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, কৃষি, এসএমই ও ব্যাংক খাত ভালো করার কারণেই দেশের অর্থনীতি এমন স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রাখা সম্ভব হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত ব্যাসেল-২ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে। ব্যাসেল-২ মোতাবেক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণের আবশ্যকতার বিপরীতে ব্যাংকগুলো গত সেপ্টেম্বর ৯.১৪ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করেছে। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করার জন্যেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জাতীয় লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের আর্থিক সেবাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে আর্থিক অন্তর্ভূক্তিকরণ বা ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন অভিযান জোরদার করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতকে সামাজিক দায়বোধ প্রণোদিত অর্থায়নে উদ্বুদ্ধ রাখাসহ দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, এসএমই ও পরিবেশবান্ধব খাতগুলোতে অর্থ যোগানে বাংলাদেশ ব্যাংক গত প্রায় পাঁচ বছর ধরেই বিভিন্ন জনহিতকর উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে।
আর্থিক অন্তর্ভূক্তিকরণ প্রক্রিয়া গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে। আর কৃষি, এসএমই ও ব্যাংকিং খাত ভালো করার কারণেই দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোকে এমন বৈরি পরিস্থিতিতেও খানিকটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রাখা সম্ভব হয়েছে। । দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও ডিজিটাইজড করতে হাতে নেওয়া হয়েছে নানান কার্যক্রম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর/ জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর