ঢাকা: মহাজোট সরকারের গণমুখী ও শিক্ষাবান্ধব নানামুখী কার্যক্রমের ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু দৃশ্যমান এ অগ্রগতিকে ম্লান করে দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
বিদায়ী বছরের শুরু থেকে রাজনৈতিক উত্তাপ শিক্ষাখাতকে বাধাগ্রস্ত করলেও নভেম্বরে বিঘ্নিত হয়েছে ক্লাস-পরীক্ষা। ডিসেম্বরে এসে সেই উত্তাপ কয়েকগুণ বেড়ে শিক্ষার আলোকে ম্লান করে দিয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষাখাত।
শিক্ষাখাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন মহাজোট সরকারের আমলেই হয়েছে বলে দাবি করেন মহাজোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং নির্বাচনকালীন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট তারিখে বই বিতরণ, ক্লাস-পরীক্ষা শুরু এই সরকারেরই প্রচেষ্টার ফল।
তবে প্রতিহিংসার রাজনীতি গত কয়েক মাসে শিক্ষাখাতকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে বলে মনে করেন নাহিদ।
শিক্ষামন্ত্রী জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে হানাহানির পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার আহ্বান জানান।
জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের মধ্যে সর্বশেষ প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীর ৬টি বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এর আগে জেএসসি ও জেডিসিতে ১৭টি বিষয়ে, এসএসসিতে ৪১টি ও এইচএসসিতে ৩৭টি বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়।
সমাপনী পরীক্ষায় প্রায় ৩০ লাখ এবং জেএসসি-জেডিসিতে ২০ লাখ ক্ষুদে পরীক্ষার্থীকে ভোগান্তিতে ফেলেছে হরতাল-অবরোধ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে অব্যাহত রয়েছে কড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই হরতাল-অবরোধেও প্রায় চার কোটি পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলোমেলো হয়ে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষ ও ভর্তি পরীক্ষা।
তবে সরকারের অন্যতম সাফল্য জাতীয় শিক্ষানীতি’২০১০ প্রণয়ন, যার বাস্তবায়নও চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’২০১০ প্রণয়ন ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি’২০১১ প্রণয়ন করেছে সরকার। ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ আইন পাস করে এর বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নও করা হয়েছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদানের ধারাবাহিকতায় বিগত চার বছরে প্রায় ৯২ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে সরকার। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবসে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। নতুন বছরে ৩০ কোটি বই বিতরণের কথা রয়েছে।
এ সরকারের চার বছরে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে ক্লাস-পরীক্ষায়। স্কুলে ১ জানুয়ারি ও কলেজে ১ জুলাই ক্লাস শুরু, ১ নভেম্বর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা, ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা, ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু এবং ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশিত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও কমে গেছে। ২০০৮ সালে মাধ্যমিক ও সমমান পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ২৩ হাজার ৫০০ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।
প্রাথমিক, মাদ্রাসা ও মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের জেন্ডার সমতা অর্জিত হয়েছে। এ জন্য পৃথিবীতে মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে জাতিসংঘে প্রশংসাও কুড়িয়েছে বাংলাদেশ।
গত পৌনে পাঁচ বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে এক কোটি ৩২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৯ জন ছাত্র-ছাত্রীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে বিদায়ী বছর স্নাতক পর্যায়ে এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ জন ছাত্রী উপবৃত্তি পেয়েছেন।
১৭ বছর পর পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করে সংস্কার ও নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তন এবং চার লাখ ৪৫ হাজার ৭৮৫ জন শিক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে সরকারি পলিটেকনিকে ডাবল শিফট চালু করেছে সরকার।
প্রায় সাত হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণ, এক হাজার মাদ্রাসায় নতুন বিল্ডিং নির্মাণ, ৩১টি মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু এবং ৩৫টি মডেল মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে।
২০১৩ সালে সরকারের বড় সাফল্য ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করা। প্রাথমিক স্কুলে লক্ষাধিক নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৩১০টি মডেল স্কুল স্থাপন কার্যক্রম গ্রহণ, উচ্চশিক্ষা প্রসারে নতুন ৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, আরো ৬টি স্থাপনের উদ্যোগ এবং নতুন ১৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরে নতুন ১১টি সরকারি স্কুল ও ৬টি সরকারি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।
সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে ৫ বছরে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে এক কোটি, ঝরে পড়াও কমছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের দ্বন্দ্ব থেকে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা মুক্ত হয়েছে।
এসবের পরেও শিক্ষাখাতে সরকারের কিছু ব্যর্থতা রয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি, শিক্ষা আইনও চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার।
বেশ কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।
সদ্য সমাপ্ত সমাপনী পরীক্ষায়ও কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। তবে সরকার বলছে, ইংরেজি ও বাংলায় প্রমাণ মিললেও তা আংশিক। এছাড়াও গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ফলে ১৭ জেলায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
তবে সরকার এসব ব্যর্থতাকে ঢেকে আরও এগিয়ে যেতে চায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: খুররম জামান, ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর