ঢাকা: বিদায়ী ২০১৩ সালে একের পর এক সংকট অক্টোপাসের মত আকড়ে ধরেছিলো পোশাক শিল্পকে ।
বছরের শুরুই হয় তাজরিন ফ্যাশানের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতের নেতিবাচক প্রভাবকে সঙ্গে নিয়ে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ শিল্প বিপর্যয় হিসেবে পরিগণিত হয় এ ট্র্যাজেডি।
রানা প্লাজার ধাক্কা সামলাতে যখন অস্থির প্রশাসন-মালিকপক্ষ তখনই ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন।
সর্বশেষ দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পটি যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে রাজনৈতিক সহিংসতায়।
২০১২ সালের শেষের দিকে তাজরিন কারখানার অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন নিহত হওয়ার পর পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য জোর তাগিদ চলে ২০১৩ সালের জানুয়ারির শুরু থেকেই।
কিন্তু তারপরও পোশাক শিল্পের অর্ডার কমতে থাকে উল্লেখযোগ্য হারে। ভবন মালিক রানার প্রতারণা ও কারখানা মালিকদের অসচেতনতায় বিদায়ী বছরের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে নয়টায় ধসে পড়ে রানা প্লাজা। নিহত হন ১১২৬ জন মানুষ। এখনো নিঁখোজ রয়েছেন অনেকেই।
রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির কিছুদিন পরেই নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হয়ে যায় জিএসপি সুবিধা। হুমকির মুখে পড়ে যায় পুরো রফতানি বাণিজ্য। সরাসরি জিএসপি সুবিধার অর্ন্তভুক্ত না হলেও জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের জন্য স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ইমেজ সংকটে পড়ে পোশাক শিল্প।
১৯৭৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু গত ২৭ জুন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রম অধিকার ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না অভিযোগ করে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের কর্মপরিবেশ উন্নত করতে শর্তগুলো বাস্তবায়নে অগ্রগতির চিঠি গেলেও চলতি বছরে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হবে না জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
এমনকি আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে কবে নাগাদ এই সুবিধা পুনর্বহাল হওয়ার সম্ভাবনা আছে সে সম্পর্কে কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ। তবে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের বিষয়ে সর্বাত্মক কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল কার্যক্রমের অগ্রগতি বিষয়ক চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব।
অন্যদিকে রানা প্লাজা ধ্বসের পর পরই চলতি বছরের মে মাস নাগাদ ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর তাগিদে রাজপথে নেমে আসে শ্রমিক পক্ষ।
চলতে থাকে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর। বন্ধ হয়ে যেতে থাকে একের পর এক কারখানা।
পরিস্থিতি শান্ত করতে চলতি বছরের ৬ জুন পোশাক শ্রমিকদের বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণে সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ একে রায়কে চেয়ারম্যান করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট এই মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। এ বোর্ডে একজন নিরপেক্ষ সদস্য, পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিক পক্ষের দুজন স্থায়ী সদস্য এবং পোশাক কারখানা মালিক পক্ষের দু’জন প্রতিনিধি ছিলেন।
তারপরও পরিস্থিতি শান্ত না হলে মালিকপক্ষ আলোচনায় বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা মেনে নেন মালিকরা। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২১ নভেম্বর ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের ১০ম বৈঠকে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এসব প্রতিবন্ধকতায় দেশের পোশাক শিল্পের জন্য সব চেয়ে বড় মেলা বাটেক্সপো-২০১৩ এর আয়োজন করা হলেও তার উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় বিজিএমইএ।
মেলায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যেমন কমেছে ঠিক তেমনি আশানুরূপ ক্রেতাদের সাড়াও মেলেনি বাটেক্সপো-২০১৩তে। ১০ অক্টোবর শুরু হওয়া মেলা শেষ হয় ১২ অক্টোবর।
২০১২ সালে এই মেলার আয়োজন করা হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে স্টলের সংখ্যা ছিলো ১৩৮টি। আর এবার স্টলের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮০টি।
অন্যদিকে দেখতে দেখতে ২৪ নভেম্বর কেটে যায় তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের এক বছর। নিশ্চিন্তপুরের মানুষের নাকে পোড়া গন্ধ লেগে থাকলেও ডিএনএ টেস্টে পরিচয় মেলেনি ১৩টি লাশের।
বিজিএমইএ’র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালে প্রায় ২৮টি কারখানায় আগুন লাগে। এর মধ্যে ২৯ নভেম্বর স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১০ তলা ভবন। ক্ষতি হয় প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা।
এছাড়াও আসওয়াদ নিটওয়্যারসহ বেশ কয়েকটি পোশাক শিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলতি বছরে। এসব ঘটনায় একাধিক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন।
সব সংকট কাটিয়ে যখন সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল দেশের পোশাক শিল্প, তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সংকট।
হরতাল, অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একদিকে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে অন্যদিকে ক্রেতারা সরিয়ে নিয়েছে তাদের অর্ডার। চলতি বছরে রাজনৈতিক সংকটসহ অন্যান্য কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমনটাই জানা যায় বিজিএমইএ’র সূত্র থেকে।
বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মো.শহীদুল্লাহ আজীম বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালটি পোশাক শিল্পের জন্য অত্যন্ত খারাপ গিয়েছে। নানা সংকট কাটিয়ে আমরা যখন দাঁড়াতে গেলাম তখন রাজনৈতিক সহিংসতায় এখন ক্রেতারা আমাদের দেশে আসতে ভয় পাচ্ছে।
অর্ডার দিচ্ছে না। গত ৩০ বছরে পোশাক শিল্পের জন্য এটিই সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। চলতি বছরে দেশের পোশাক শিল্প ৪০ শতাংশ পিছিয়ে পড়েছে। আমরা চাই আগামীতে অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘেœ ব্যবসা করতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করা হোক।
বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলানিউজকে বলেন, পোশাক শিল্পের জন্য চলতি বছরটি ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ধাক্কা আমরা যখন কিছুটা সামলে নিয়ে এসেছি, তখনই রাজনৈতিক সহিংসতায় আমারা আবার পিছিয়ে যাচ্ছি।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, এখন এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে আগামীতে সরকারকে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হয়, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো ক্ষতি না হয়। নয়তো আমাদের অর্ডার পাশের রাষ্ট্রগুলোতে চলে যাবে।
ইতোমধ্যে ভারত আর কিছুদিনের মধ্যে জিএসপি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। তারা এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা রাজনৈতিক কারণে কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে আগামীতে এ শিল্প ধরে রাখতে হলে সরকারকে এমন নীতি নিতে হবে, যাতে মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষই বাঁচে। শুধু মালিকদের ইনসেনটিভ দিলেই চলবে না। তাতে শ্রমিকরাও তাদের অংশটা যেন পান, সে বিষয়েও নজর রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: খুররম জামান, ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর