ঢাকা: বিদায় ঘণ্টা গুণছে ২০১৩ সাল। রাজনৈতিক অস্থিরতায় উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য ছাড়াই শেষ হচ্ছে মহাজোট সরকারের সর্বশেষ বছর।
অন্যদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগামী বছর অর্থনীতির অবস্থান সুসংহত হবে- এমনটা আশাও করা যাচ্ছে না। তারপরও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলেও প্রবৃদ্ধির ধারা পুনরুদ্ধার করা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ সব দিক বিবেচনা করলে আগামী বছরেও অর্থনীতির সাফল্য বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়েই থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার আগেই ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। পরে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিও অনুকূলে নেই। বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় সামনে বিনিয়োগকারীরা ঋণও নেবেন না। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে কি না এমন সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেও অর্থনীতির এ নাজুক অবস্থা উত্তরণে সামনে বেশ বেগ পেতে হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সঠিক নীতি গ্রহণ করতে না পারলে দেশের অর্থনীতির আরও অবনতি হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সাধারণ মানুষও।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রতিকূলে রয়েছে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও। গার্মেন্টস সেক্টরেও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে সমঝোতা না হলে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে।
মূল্যস্ফীতি
বিদায়ী বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাজনৈতিক সহিংসতা আর অস্থিরতায় বছরের শেষ নাগাদ তা বাড়তে শুরু করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে নতুন বছরের শুরুতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির ওপরে। মূলত হরতালের প্রভাবেই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বছর শেষে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারে। তবে খাদ্যবহির্ভূত খাতে পণ্য ও সেবার মূল্য কিছুটা কমায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তথ্যকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। নভেম্বরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশে।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি
বিদায়ী বছরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে আগামী বছরেও এর প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য মতে, গত ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ২৫৪ কোটি ডলারের।
এর মধ্যে অক্টোবরে সর্বনিম্ন দুই কোটি মার্কিন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। আগস্টে তিন কোটি এবং সেপ্টেম্বরে ১৯৩ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১২ সালে নিবন্ধিত হয় ২৬১ কোটি ১৩ লাখ এবং ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয় ৬৪৪ কোটি ৮১ লাখ ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব। অর্থাৎ ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ৬০ শতাংশ। সামনে বিনিয়োগ আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে স্থানীয় বিনিয়োগেও ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে নিবন্ধন প্রস্তাব কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০১৩ সালের গত ১০ মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে ৪২৭ কোটি ৪২ লাখ মার্কিন ডলার। অথচ গত বছরেও নিবন্ধিত হয়েছে ৬০৮ কোটি ডলার।
আর্থিক খাত
২০১২ সালে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ২০১৩ সালেও আর্থিক খাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সে ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ১৭০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি আছে। এ ঘাটতি মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও বিদায়ী বছর ব্যাংকিং খাতের মুনাফায় ধস, নতুন নয় ব্যাংকের অনুমোদন ছিল আলোচিত বিষয়।
সম্প্রতি ২০১৩ সালকে ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়ের বছর উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক পর্যালোচনায় বলেছে, মুদ্রানীতি মুদ্রা প্রবাহ ও সম্পদ গঠনে বাস্তবসম্মত হয়নি।
বাংকিং খাতে কু-ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে এ খাত। কু-ঋণের পরিমাণ ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। অতিরিক্ত ব্যাংক সুদের হার ও আর্থিক খাতের সংস্কার করা হয়নি, এমনকি উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
ব্যাংকিং খাতে এতো সব দুঃসংবাদের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা আশার আলো জাগায়। যদিও অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নাজুক হওয়া, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে স্থবিরতা থাকায় বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ বেড়েছে।
রাজস্ব খাত
অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের তুলনায় রাজস্ব খাত অনেকাংশেই পিছিয়েছে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের চিত্রও একই। রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত থাকলে এবারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এনবিআর সূ্ত্র বলছে, ২০১৩ সালের জুলাই-অক্টোবর মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৯২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা আদায়ের। অর্থাৎ চার মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না আসলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে সরকার বাজেট অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর হয়ে পড়বে। যার প্রভাবে অর্থবছরের শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রফতানি আয়
তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় রফতানি আয়ের প্রধান খাত নিট-ওভেনে আয় কমেছে। সম্প্রতি গাজীপুরের স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানার আগুন এ খাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন ও জাহাজে প্রেরণ করতে না পারায় পোশাক খাতের অনেক অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশে চলে গেছে। আগামী বছরও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্র বলছে, বছরের প্রথম ৬ মাস রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে ২২৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ২২৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও অক্টোবরে রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ কম হয়েছে। নভেম্বরে ২২৬ কোটি ৫ হাজার মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ২১১ কোটি ৯২ লাখ ডলার।
শেয়ারবাজার
একে একে তিনটি বছর পার হয়ে গেলেও ২০১০ সলে ঘটে যাওয়া মহাধসের রেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশের শেয়ারবাজার। আগের দুই বছরের মতো চলতি বছরেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। বছরের শেষ সময়ে এসে নভেম্বর থেকে কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস মিললেও তা স্বাভাবিক মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। তা ছাড়া অর্থনীতির অন্যখাতের যে অবস্থা তাতে খুঁড়িয়ে চলা শেয়ারবাজরকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো চ্যালেঞ্জই হবে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি
সব দিক বিবেচনায় চলতি অর্থবছর কাঙ্ক্ষিত মোট দেশজ উৎপদান (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে কি-না তা একটা প্রশ্ন হয়ে থাকবে। কারণ, অর্থবছরের শুরুতে অর্থনীতির সূচকগুলো ছিল নিম্নগামী। এছাড়া নির্বাচনী বছরের শেষ সময় হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দাতা সংস্থাগুলোও ইঙ্গিত দিচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় কমবে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশের নিচে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসবে। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর