ঢাকা: ১২. ১২. ১৩। বৃহস্পতিবার।
এর ঠিক একদিন আগে ১০ ডিসেম্বরে ফাঁসি কার্যকর করা হবে এমন একটা কথা বাতাসে ভাসলেও জামায়াতের আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত রিভিউ করে সেটি স্থগিত করেন। আর তাই হয়তো জনগণের মনের সেই ধোঁয়াশাটা কাটতে সময় লাগছে; তারা সবার কাছে জানতে চাইছেন ফাঁসি কার্যকর আসলেই করা হবে কিনা।
মূল ফটকের সামনে রয়েছে অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, রয়েছে সাদা এবং নীল রঙের দুটো অ্যাম্বুলেন্স। কঠোর নিরাপত্তা, কারাগারের চারিদিকের রাস্তাগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে, সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ, তল্লাশি করা হচ্ছে সবাইকে। আশেপাশের উঁচু দালানগুলোর ছাদেও অবস্থান নিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সতর্ক দৃষ্টি চারিদিকে।
কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের ওপরে যে দেয়াল ঘড়িটা রয়েছে সেটিতে যখন ১০ টা বেজে ০১ মিনিট তখন একটু কেমন যেন গুমোট হয়ে গেল পরিবেশ। একেকজন পাশের জনের দিকে তাকাচ্ছে, মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, চোখের প্রশ্নটা খুব সহজেই চোখে পড়ে।
অনেকেই জানে ১০ টা ০১ মিনিটেই হবে বাংলাদেশের পাপমোচনের প্রথম ধাপের সূচনা। সেই পথ ধরে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, ইতিহাসের ঋণশোধ করার নয়, তবে দায় শোধ করার একটা তাড়া তো রয়েছেই।
এক এক করে সেকেন্ডের কাঁটা এগিয়ে চলে, এগিয়ে চলে মিনিটের কাঁটা। সময় এগিয়ে যায়, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো খবর আর আসে না, ১০টা ১০ কিংবা এর একটু পর সম্বস্বরে একটা চিৎকার ওঠে: হয়ে গেছে, ফাঁসি হয়ে গেছে।
মনে পড়ে, সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও...
বাংলার মুক্তিকামী মানুষ, শহীদপরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সহ মুক্তিযুদ্ধকে যারা চেতনায় ধারণ করেন তাদের জন্য এ-এক মাহেন্দ্রক্ষণ। কবি মেহেরুন্নেছা, কলেজছাত্র পল্লব সহ অগণিত বাঙালির রক্তে যার হাত লাল হয়েছিল, যার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘কসাই কাদের’, সেই কসাই কাদেরকে ইতিহাস তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলো। প্রমাণিত হলো, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, নাথিং গোজ আনপেইড।
গণমাধ্যমকর্মীরা ব্যস্ত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে খবরটি দেয়ার জন্য। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো সাদা নীল অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে ঢুকে গেল মূল ফটক পেরিয়ে। এরই মধ্যে ভেতর থেকে বেরিয়ে কোনো কথা না বলে হেঁটে চলে গেলেন ফাঁসির সময়ে উপস্থিত থাকা ঢাকার সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা।
১১ টা ১৬ তে কারাগারের ভেতরে থাকা আরেকটি সাদা অ্যাম্বুলেন্স সহ বাইরে থেকে ঢোকা দুটি অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে এলো কাদের মোল্লার লাশ সহ। আগে থেকেই জানা ছিল, লাশ চলে যাবে কাদের মোল্লার গ্রামের বাড়ী ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে। কারাগারের মূল ফটকের সামনে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির যে গাড়িবহর অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, সেগুলো সাইরেন বাজাতে শুরু করলো। তিনটি অ্যাম্বুলেন্সকে মাঝখানে রেখে দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করলো গাড়িবহরটি।
কিন্তু তখনও তো একটা আনুষ্ঠানিকতা বাকি। কারাগার থেকে কেউ তো গণমাধ্যমকে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে একথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় নি! অগত্যা কারাগার কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা। অবশেষে এলেন আইজি প্রিজন নূর মোহাম্মদ। কিন্তু তিনি এসে আনুষ্ঠানিকভাবে যা জানালেন তার মর্মার্থ হলো: কারাবিধি অনুযায়ী এ ধরনের ফাঁসির কথা ব্রিফিং করে বলার নিয়ম নেই। অর্থাৎ তিনিও ঝেড়ে কাশলেন না।
আশাহত হয়ে সবাই যখন অফিস কিংবা বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি, তখনই খবর এলো, হুসেইন মো এরশাদকে আটক করা হতে পারে, তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ক্রাইম বিটের উপস্থিত সাংবাদিকদের বেশিরভাগই ছুটলেন বারিধারার প্রেসিডেন্টপার্কের উদ্দেশ্যে।
এর মধ্যেই কে যেন একজন বললেন: এতোক্ষন ছিলাম রাজাকারে, এখন যাচ্ছি স্বৈরাচারে।
সেই সন্ধ্যা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গণমাধ্যমে কাজ করা মানুষগুলো সবাই এবার ফেটে পড়লেন সাম্মলিত অট্টহাসিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর