ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

রাজনীতির টেবিল থেকে আকাশপথে ‘পেঁয়াজ’

ইয়াসির আরাফাত রিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৯
রাজনীতির টেবিল থেকে আকাশপথে ‘পেঁয়াজ’ রাজনীতির টেবিল থেকে আকাশপথে ‘পেঁয়াজ’

ঢাকা: বছরের শেষভাগে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ‘পেঁয়াজ’। কারণ ২৫-৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজের দাম চলে যায় আড়াইশ টাকারও ওপরে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এই দাম বাড়ানোর কাজ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। ডিসেম্বরে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও স্বাভাবিক হয়নি, যদিও দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হয়েছে। 

রাজনীতির টেবিল থেকে সামাজিক মাধ্যম, স্কুল-কলেজ, গণমাধ্যমে সরব ছিল পেঁয়াজের আলোচনা। চাহিদা মেটাতে প্রথমবারের মতো দেশে আকাশপথে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।

কিন্তু সেই পেঁয়াজ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বাজারে। পরে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে করেই পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তবে এক্ষেত্রে দীর্ঘ সূত্রিতা আর দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। অনেক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দিলেও আনেননি।

পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনা শুরু হয় মূলত ঈদুল আজহার দুই-তিন সপ্তাহ আগে (জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ)। আগে পেঁয়াজের দর ২৫-৩০ টাকা থাকলেও সেসময় হঠাৎ করেই ৪০ থেকে ৫০ টাকায় উঠে যায়। এরপর থেকে বাড়তি দামেই পেঁয়াজ বিক্রি চলতে থাকে। এর মধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর এক দিনের ব্যবধানে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম দুই গুণ হয়ে যায়। দেশে শুরু হয় পেঁয়াজের অস্বাভাবিক সংকট। বাড়তে থাকে দাম।

এ পেঁয়াজ সংকট মোকাবিলায় সরকার তাৎক্ষণিক মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। দেখা যায় সেই পেঁয়াজের তিন ভাগের এক ভাগই পচা। এরপর মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান ও চীন থেকে শুরু হয় আমদানি।

এ সময়ের মধ্যে দাম কমার পরিবর্তে দফায় দফায় দাম বাড়তে থাকে। দেশি পেঁয়াজ চলে যায় ২৭০ টাকায়। আর আমদানি করা পেঁয়াজ দাম বেড়ে হয় ২৫০ টাকা। এ সংকট চলতে থাকে খুচরা-পাইকারি বাজারের দরদামের পার্থক্য (হাতবদল) আর অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির আশ্বাস ছিল, শিগগিরই কমে আসবে পেঁয়াজের দর। বারবার তিনি একই আশ্বাস দিতে থাকেন। সব শেষে বলেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে মন্ত্রীর আশ্বাসের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি বাজারে।

রাজনীতির টেবিলে পেঁয়াজ:
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অধিকাংশই পেঁয়াজ সংকটের মুখে কাঁদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। তাদের অনেকেই পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কেউ বলেছেন, সরকার দেশ চালানোয় ব্যর্থ। যারা পেঁয়াজের বাজার ঠিক করতে পারে না, তারা দেশ চালাতে পারে কীভাবে!

সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, কুচক্রী ব্যবসায়ীদের বিচার হবে। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।  

টিসিবির উদ্যোগ:
অন্যদিকে নাগরিকদের মাঝে স্বল্পমূল্যে পেঁয়াজ পৌঁছে দিতে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ট্রাক সেলযোগে ৪৫ টাকা কেজিপ্রতি পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিটি ট্রাকে এক হাজার কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে টিসিবির ট্রাক সেলে বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমে এখন তা বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫ টাকায়। জনপ্রতি ২ কেজির পরিবর্তে এখন চাইলেই ৫ কেজি পর্যন্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিদিনই ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি চলছে।  
 
পেঁয়াজের প্লেনযাত্রা:
দেশের পেঁয়াজ বাজারের অস্থিরতা মোকাবিলায় শাদ এন্টারপ্রাইজ- এস আলম গ্রুপ আকাশপথে পেঁয়াজ আমদানির তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেয়। আকাশপথে পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দর থেকে পেঁয়াজের প্রথম চালান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় গত ২৯ নভেম্বর। এদিন সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে বেসরকারি সিল্ক সংস্থার পণ্য পরিবহনকারী উড়োজাহাজে এই চালান আমদানি হয়।

আকাশপথে চারটি উড়োজাহাজে পেঁয়াজের চালান আনার সময়সূচি ঠিক হয়, চলেও আসে দেশে। এর মধ্যে সিল্ক সংস্থার পণ্য পরিবহনকারী উড়োজাহাজ ছাড়াও সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী প্লেন, বিসমিল্লাহ এয়ারলাইন্সের পণ্যবাহী উড়োজাহাজ এবং সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজযোগে আসে পেঁয়াজ। এর মধ্যে সরকারের মন্ত্রী জানান, প্লেনে করে আনতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের ভাড়া পড়েছে ১৫০ টাকা।  

অপরিপক্ব পেঁয়াজ আসে বাজারে:
পেঁয়াজের দাম যখন আকাশছোঁয়া তখন কৃষকের উদ্যোগে বাজারে আসে গাছসহ অপরিপক্ব পেঁয়াজ। নভেম্বরের শেষ দিক থেকে এসব পেঁয়াজ আসে, যা ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা দেখা গেছে। দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতার আগ্রহ বাড়ে এ পেঁয়াজে। এখনও বাজারে এসব পেঁয়াজ আছে, তবে দাম কমেছে প্রায় তিন গুণ। বর্তমানে এসব গাছসহ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যেই।

রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কম হওয়া:
দাম বেশি হলে চাহিদা কমে আসে এটা স্বাভাবিক। দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার করেননি বলে দাবি করেছেন। তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আছে ‘হোটেলের রান্নায় পেঁয়াজ ছাড়াই পেঁয়াজু, ডিম মামলেট, মোগলাই তৈরির চিত্র।
 
সামাজিক মাধ্যমে পেঁয়াজ:
দেশের বাজারে যখন পেঁয়াজ সংকট চরম আকারে, তখন এক শ্রেণির মানুষ এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে। অনেকেই ডিমের মতো পেঁয়াজের হালি বিক্রির ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। কেউ কেউ পেঁয়াজের গহনা তৈরি করে উপহার দেন প্রিয়জনকে। যা ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।

উপহার হিসেবে পেঁয়াজ:
দেশের মধ্যে কোনো অনুষ্ঠানে স্বর্ণ, তৈজস পণ্য, পোশাক উপহার হিসেবে দেওয়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে পেঁয়াজ উপহার, তাও আবার বিয়ের অনুষ্ঠানে! হ্যাঁ, দেশে পেঁয়াজের চলমান সংকটে এমন ঘটনাও ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় ঘটে এ ঘটনা। বিয়ের অনুষ্ঠানে নবদম্পতিকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় পেঁয়াজ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৯
ইএআর/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।