ঢাকা: গেলো বছরের শুরুটা ভালোই ছিল। শ্রেণিকক্ষ, স্কুল-কলেজের আঙিনা আর খেলার মাঠে চঞ্চলতা ছিলো শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পেরে ঘরবন্দি অবস্থায় পরীক্ষাবিহীন বছরও পার করেছে শিক্ষার্থীরা, শ্রেণি পরীক্ষার পাশাপাশি বড় পাবলিক পরীক্ষাও হয়নি করোনা মহামারির বছর।
টানা ছুটি চলছে শিক্ষায়
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। দফায় দফায় বাড়ানো হয় এই ছুটি। সবশেষ দফা বাড়িয়ে আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি।
মোবাইল-টিভিতে চোখ শিক্ষার্থীদের
ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে গত ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টিভিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস দেখানো শুরু করে সরকার।
টিভির এই ক্লাস দেখে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ করে স্কুল খোলার পর তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে জমা দিতে বলা হয়। বাড়ির কাজের উপর প্রাপ্ত নম্বর শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানানো হয়েছিল।
‘আমার ঘরে আমার ক্লাস’ শিরোনামে জাতীয় সংগীত ও করোনা সচেতনতা দিয়ে সকাল ৯টায় সংসদ টিভিতে ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আটটি বিষয়ের ক্লাস হয়। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওইসব ক্লাস পুনঃপ্রচার করা হয়। এ কার্যক্রম চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত।
মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পর প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টিভিতে ৭ এপ্রিল থেকে ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনামে ক্লাস শুরু হয়।
পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে সংসদ টিভির পাশাপাশি বেতারের মাধ্যমে প্রাথমিকের ক্লাস সম্প্রচার শুরু হয় ১২ অগাস্ট। বাংলাদেশ বেতারের এএম-৬৯৩ মেগাহার্টজে এবং এফএম ব্র্যান্ড ও কমিউনিটি রেডিওতে এই ক্লাসের সম্প্রচার শুরু করে। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় দূর শিক্ষণ পদ্ধতিতে বেতারে ‘ঘরে বসে শিখি’ স্লোগানে ক্লাস সম্প্রচার করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পর ১২ এপ্রিল তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেশের সব কলেজের অধ্যক্ষদের নির্দেশনা দেয় সরকার।
এরপর উচ্চ শিক্ষা স্তরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালুর উদ্যোগ নেয়। অনলাইনে ক্লাস নিতে স্মার্টফোন কিনতে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি।
এভাবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে যে ক্লাস হয়েছে তা ভবিষ্যতে চালিয়ে নিতে শিক্ষকদের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
একে একে সব পরীক্ষা বাতিল
করোনার প্রকোপ না কমায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থবিরতার মধ্যে শ্রেণি পরীক্ষা থেকে বছরের গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হতে হয় সরকারকে। শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান ছুটিও গড়ায় নতুন বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত।
মহামারির কারণে এবছর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী, অষ্টমের সমাপনী ছাড়াও এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। নভেম্বরে প্রথমিক স্তরের পরীক্ষায় ৩০ লাখ এবং অষ্টমের জেএসসি-জেডিসিতে প্রায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষার বদলে নিজ প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়নের সনদ দেওয়া হবে।
শুধু প্রাথমিক ও অষ্টমের সমাপনী নয়, এবারের এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিল করা হয়। পরীক্ষা বাতিল করে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে অন্যান্য শ্রেণিগুলোয় পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইউজিসি।
আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
এইচএসসির ফি ফেরত, অন্যগুলোয় জটলা
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের পর ফরম পূরণের কিছু টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড।
পরীক্ষা কেন্দ্র ফি থেকে কিছু অংশ, ইনভিজিলেটর ফি, ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি থেকে শিক্ষার্থীরা অর্থ ফেরত পাবে বলে জানান আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক।
বছরের আড়াই মাস ক্লাস হলেও পুরো বছরের টিউশন ফি নিতে বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক হতে বললেও বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ভাবিয়ে তুলেছে অভিভাবকদের। মাউশি কেবল টিউশন ফি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরো ফি গ্রহণ করছে শিক্ষার্থীদের।
এবার সব শ্রেণিতে লটারি
দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর শুধু প্রথম শ্রেণিতে অনলাইনে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও এবছর প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারিতে ভর্তি করা হবে। পরীক্ষা না নিয়ে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
করোনাকালে শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সমন্বয়ের গঠিত কমিটির প্রথম সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পলিটেকনিকে যে কোনো বয়সে ভর্তি
২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের সরকারি পলিটেকনিকে যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। তবে এতে খুব বেশি সাড়া মেলেনি। আর এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো মহলের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা।
শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি
এবছর বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের ৬০৯ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। গত ৩০ জুলাই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির উদ্যোগ থাকলেও তা আর হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
এমআইএইচ/এএ