ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

ভার্চ্যুয়াল আদালত নিয়ে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
ভার্চ্যুয়াল আদালত নিয়ে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা

ঢাকা: করোনা মহামারি পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ধরন। যোগাযোগের পুরনো পদ্ধতির বদলে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার।

বিচার কার্যক্রমেও এসেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন বৈপ্লবিক না হলেও পদ্ধতিগত বেশকিছু নতুনত্ব এসেছে। আইনি কাঠামোতেও স্থান পেয়েছে সেই পরিবর্তন। যার মধ্যে ভার্চ্যুয়াল আদালত অন্যতম।  

সরকার অধ্যাদেশ জারি করে ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থা চালু করেছে। অধস্তন আদালত ভার্চ্যুয়ালি না চললেও উচ্চ আদালতে চিরাচরিত পদ্ধতির সঙ্গে চালু আছে এই পদ্ধতি। করোনায় আইনজীবীদের পোশাকেও এসেছে পরিবর্তন। বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে আইন অঙ্গনের এই পরিবর্তন ছিল আলোচিত বিষয়।

ভার্চ্যুয়াল আদালত: সারা বিশ্বের মতো করোনা ঝড়ের কবলে পড়ে বন্ধ করে দিতে হয় বাংলাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি দফতর ও কলকারখানা। যার ব্যতিক্রম নয়, আইন অঙ্গনও। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির ফলে ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল অন্য সরকারি দফতরগুলোর মতো আদালতও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দেড় মাস পুরোপুরি বন্ধ থাকার পর আইনজীবীদের আর্থিক দুর্গতি ও বিচার প্রার্থী মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু করা হয়।

গত ৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। দু’দিন পর ৯ মে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা ক্ষেত্রমত হাইকোর্ট বিভাগ, সময় সময়, প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) জারি করতে পারবে।

অধ্যাদেশ জারির পরদিন মে মাসের ১০ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই অনুযায়ী ১২ মে সারা দেশে সীমিত পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত শুরু হয়। প্রথম দিকে শুধু হাজতি আসামির জামিন শুনানির জন্য এই ব্যবস্থা চালু হয়। পরবর্তী সময়ে আদালতের অন্য কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। অধ্যাদেশটি গত ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে পাসের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়।

এতে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাই থাকুক না কেন, যে কোনো আদালত এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারি করা প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীদের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে কোনো মামলার বিচার বা বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য গ্রহণ বা যুক্ততর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় দিতে পারবে।

শুরুর দিকে ভার্চ্যুয়াল আদালত নিয়ে আগ্রহ থাকলেও এর পদ্ধতিগত জটিলতা নিয়ে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। কারণ ভার্চ্যুয়ালি শুনানি হলেও আইনজীবীদের মামলা প্রস্তুত করতে আগের মতোই আদালতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই এই পদ্ধতিকে ভার্চ্যুয়াল আদালতের ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতি’ বলে বর্ণনা করেন অনেকেই। এক পর্যায়ে জুলাই মাসের শুরুর দিকে নিম্ন আদালতে নিয়মিত বিচার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।

এক পর্যায়ে ঈদুল আজহার ছুটির পর ৫ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অধস্তন আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে মামলা পরিচালনায় ধীরগতির ইন্টারনেট, শুনানির লিঙ্ক পেতে ঝামেলা, অতিরিক্ত কাগজপত্র জমা দিতে অসুবিধা, ওকালতনামা থেকে শুরু করে মামলার নথিপত্র তৈরিতে আগের পদ্ধতি থেকে যাওয়ায় ভার্চ্যুয়াল আদালতকে অনেকে পুরোপুরি ভার্চ্যুয়াল বলতে রাজি হননি।

তথাপি করোনার এই মহামারিতে আদালত অঙ্গনে নতুন একটি পদ্ধতি আইনি কাঠোমোতে চালু হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ এখনো ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে শুনানি হচ্ছে। তাই এই পদ্ধতি বিচার বিভাগের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আইনি কাঠামোতে রূপ নেওয়ায় ভবিষ্যতে দেশের আদালতকে পুরোপুরি ডিজিটাল রূপ দেওয়ার একটি পথ তৈরি হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে যে কোনো দুর্যোগে আদালত চালু রাখার সুযোগও তৈরি হয়েছে।

পরিবর্তন এসেছে আইনজীবীদের পোশাকেও: করোনা মহামারিতে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর ফলে আইনজীবীদের পোশাকে কিছুটা শিথিলতা শুরুতে দেওয়া হয়। সাদা শার্টের ওপর কোট ও গাউন পরিধানের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে সাদা শার্ট-কালো টাইয়ের ওপর শুধু কালো কোট এবং উচ্চ আদালতে গলায় সাদা ক্রস ব্যান্ডের পাশাপাশি শুধু কালো কোট পরে শুনানি করার রীতি চালু হয়।

পরবর্তী সময়ে নিয়মিত আদালত খুললে আগস্টের শুরু থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিম্ন আদালতে শুধু সাদা শার্টের ওপর টাই এবং উচ্চ আদালতে ক্রস ব্যান্ড পরার বিধান করা হয়। সেক্ষেত্রে কোট ও গাউন পরার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়। পরে শীতের প্রকোপ শুরু হলে শার্টের সঙ্গে কালো টাই বা ব্যান্ডের ওপর শুধু কোট পরার বিধান চালু হয়। এক্ষেতেও গাউন পরার বাধ্যবাধকতা এখনো পর্যন্ত আরোপ করা হয়নি।

দেশের আদালতগুলোতে ব্রিটিশ পদ্ধতির কাঠামোগত বিষয়গুলোতে সহজে হাত দেওয়ার নজির দেখা যায় না। তবে করোনা মহামারির কারণে আদালতের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। আইনজীবী ও বিচারকদের পোশাকের ক্ষেত্রেও কিছুটা শিথিলতা তৈরি করা হয়। তাই করোনার কারণে একদিকে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের যেমন সংকটে ফেলে দেয়, তেমনি সংকট কাটাতে নতুন একটা সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
কেআই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।