মাদারীপুর: ০৩ মে ২০২১। সোমবার।
দুনিয়া থেকে সবচেয়ে প্রিয়জন এবং পরিবারের সব সদস্যদের হারিয়ে একা বেঁচে থাকা মীম তখনও জানে না তার আর কেউ রইলো না পৃথিবীতে!
সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার বাতাস স্বজন হারানো হাহাকারে ভারী হয়ে উঠে। ২০২১ সালে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে পদ্মা নদী। স্বজন হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের আর্তনাদে থমকে থাকে চারপাশ।
০৩ মে ভোরে শিমুলিয়া থেকে ৩১ যাত্রী নিয়ে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে একটি স্পিডবোট। দ্রুতগতির স্পিডবোটটি কাঁঠালবাড়ী ঘাটের কাছে এসে নদীর পাড়ে নোঙর করে রাখা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
ঘটনাস্থলেই ২৬ যাত্রীর মৃত্যু হয়। ভোর ৬টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটলে ৮টার মধ্যেই যাত্রীদের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। মাথায় আঘাতের ফলেই যাত্রীর মৃত্যু হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এ দুর্ঘটনায় খুলনার তেরখাদা উপজেলার পারুফল এলাকার মৃত আলম মিয়ার ছেলে এবং বেঁচে যাওয়া ছোট্ট মীমের বাবা মনির মিয়া (৩৮), মনির মিয়ার স্ত্রী হীনা বেগম (৩৬), তাদের মেয়ে রুমি আক্তার (৩) ও সুমি আক্তার (৫) মারা যান। দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি ফিরছিল মীমের পরিবার!
এ দুর্ঘটনায় আরও মারা যান শিবচর উপজেলার মৌলতীকান্দি এলাকার আজিত মোল্লার ছেলে আলম মোল্লা (৩৮), একই উপজেলার গুয়াতলা এলাকার আদম আলী মোল্লার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৪২), রাজৈর শঙ্কারদি এলাকার তারা মিয়া মীরের ছেলে তাহের মীর (৩০), সদর উপজেলার শ্রীনদী এলাকার আবদুল মান্নান মোল্লার ছেলে আবদুল আহাদ (৩০), ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার মাইগ্রো এলাকার মৃত পান্নু সরদারের ছেলে আরজু সরদার (৪০) এবং আরজুর দেড় বছর বয়সী ছেলে ইয়ামিন, বরিশালের বন্দর থানার তেদুরিয়া এলাকার মো. আলী আহমেদের ছেলে আনোয়ার চৌকিদার (৫০), বানারীপাড়া উপজেলার হাশেম ব্যাপারীর ছেলে আলাউদ্দিন ব্যাপারী (৪৫), চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানার মোহনপুর এলাকার মৃত আলী হোসেন ব্যাপারীর ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৫), নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার রাজাপুর এলাকার হাফিজুর রহমানের ছেলে জোবায়ের মোল্লা (৩০), কুমিল্লার তিতাস উপজেলার ইউসুফপুর এলাকার মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে জিয়াউর রহমান (৩৮), দাউদকান্দি উপজেলার মাইখারকান্দি এলাকার মৃত আবদুল হাশেমের ছেলে মো. কাওসার আহমেদ (৪০), একই এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. রুহুল আমিন (৩৬), মুন্সিগঞ্জের সাতপাড় এলাকার চান মিয়া শেখের ছেলে সাগর শেখ (৪১), বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আশা এলাকার রত্তু হোসেনের ছেলে সাইদুল হোসেন (২৭), একই উপজেলার পূর্বষট্টি এলাকার সাদেক ব্যাপারীর ছেলে রিয়াজ হোসেন (৩৩) ও সাইফুল ইসলাম (৩৫), একই উপজেলার মনির হোসেন (৩৫), ঢাকার পীরেরবাগ এলাকার নুরে আলমের ছেলে খোরশেদ আলম (৪৫), ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া এলাকার মৃত আবদুল কুদ্দুস শিকদারের ছেলে নাসিরউদ্দিন (৪৫), পিরোজপুর সদর উপজেলার চরখানা এলাকার মো. ওহিদুরের ছেলে বাপ্পী (২৮) এবং পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার পসারিয়াবুনিয়া এলাকার রঞ্জন অধিকারীর ছেলে জনি অধিকারী (২৬)।
এই দুর্ঘটনার পর স্পিডবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। ১৫৬ দিন বন্ধ থাকার পর চালকদের প্রশিক্ষণ, ডোপটেস্ট, স্পিডবোটের নিবন্ধন শেষে গত ০৭ অক্টোবর থেকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে পুনরায় স্পিডবোট চালু হয়।
সময় গড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। সাধারণ মানুষ ভুলে যেতে থাকে ঘটনাগুলো। সচেতনতাবোধ ভুলে আবার নৌরুটে নিয়ম ভাঙা বাড়তে থাকে। তবে ক্ষত থেকে যায় স্বজন হারানো স্বজনদের বুকে। পদ্মার ঢেউয়ে ফিরে ফিরে আসে আপনজন হারানো ভয়াল স্মৃতি!
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১
এসআরএস