রাজবাড়ী: রাজবাড়ী জেলার ক্রীড়াঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম বিনয় কুমার সাহা। বয়স ৫৩, অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেও মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করেছিলেন ফুটবল খেলা।
বিনয় স্বপ্ন দেখতেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর। রাজবাড়ীর বিভিন্ন জায়গায় তার খেলা দেখে মুগ্ধ হতেন ফুটবল প্রেমীরা।
কিন্তু মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় বিনয়ের। এরপর অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। শেষ হয়ে যায় পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। দারিদ্রতায় থমকে যায় বিনয়ের ফুটবল খেলার ক্যারিয়ার। বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে জীর্ণ ঘরে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বসবাস তার।
বিনয় কুমার সাহা রাজবাড়ী জেলা শহরের পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বিনোদপুর গ্রামের মৃত নিশিকান্ত সাহা ও মৃত কিরণ বালা সাহা দম্পতির ছোট সন্তান। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পণ্য বিক্রয় কর্মী হিসেবে চাকরি করছেন।
বিনয়ের বয়স যখন ২০-২২ বছর তখন তার বাবা মারা যান। বাবাকে হারিয়ে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তার। রাজবাড়ী শহরেরর রেলওয়ের মাঠে খেলা দেখতে আসতো। সেখানে এলাকার বড় ভাইদের খেলা দেখে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়ে। এরপর এলাকার ফুটবল প্রেমিদের সাথে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। শুরু করেন অনুশীলন।
ভালো খেলার কারণে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা, উপজেলা থেকে ডাক পান। বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলতে যান জেলার বাইরে। বাইরে খেলতে যাওয়ার জন্য ডাক পাওয়ার পর থেকেই তার ফুটবল খেলার প্রতি আরও আগ্রহ বেড়ে যায়। এভাবেই তিনি তার খেলার নৈপুণ্য দেখিয়ে জায়গা করে নেন রাজবাড়ী জেলা ফুটবল টিমে। এলাকার মাঠ কাঁপিয়ে এরপর নিয়মিত ফুটবল খেলেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মাঠে। এরপর ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তার।
ফুটবলার বিনয় বাংলানিউজকে বলেন, আমি ৩০ বছর ফুটবল খেলেছি। এর মধ্যে জেলা,উপজেলা পর্যায়ে খেলেছি। পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ,পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছি। ঢাকার মিরপুরের একটি ক্লাবের হয়েও খেলেছি। একদিন একটি টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে ডান পায়ে ব্যথা লাগে। পরে এক্সরে করে দেখি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। তখন টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারিনি। এরপর ফুটবল খেলা বাদ দিতে হয়। কিন্তু সেই সময়ে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমি পুনরায় ফুটবল খেলায় ফিরতে পারতাম।
বিনয় কুমার সাহা আরও বলেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলের হয়ে খেলবো। আমার কোচ আর দর্শকরা বলতেন জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনা রয়েছে আমার। কিন্তু তৎকালীন সময়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা দরকার ছিল আমার পায়ের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু আমার দরিদ্র পরিবার চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারেনি। আমি অনেকদিন অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই ছিলাম। ফলে মাঠের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়। পরে খেলোয়াড় হিসেবে আর মাঠে নামা হয়নি। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ফুটবল ছাড়লেও মাঠ ছাড়া হয়নি। পরবর্তীতে আমি রেফারি হিসেবে ফুটবল খেলা পরিচালনা শুরু করি।
তিনি আরো বলেন, খেলতে গেলে পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন বাধা আসে। আমি অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বাবা-মা বাধা দিতেন। মা দুপুরে রোদের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না। তখন বাড়ির জানালা দিয়ে পালিয়ে এসে খেলা অনুশীলন করেছি। ফুটবলের প্রতি এমনই ভালোবাসা ছিল। কিন্তু বর্তমানে আমাদের বাচ্চাদের মধ্যে তো খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। তারা খেলাটাকে প্যাশন নিতে পারে না। তারা মোবাইলে পাবজি আর ফ্রি ফায়ার নিয়ে থাকে। তাই অভিভাবকদের কাছে আমার আবেদন বাচ্চাদের মাঠে নিয়ে আসুন। মাঠে এলে তারা খেলার মধ্যে থাকবে, মাদক থেকে দূরে থাকবে। সমাজের জন্য কিছু দিতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, যারা ফুটবল খেলে তারা বেশিরভাগই গরিব ঘরের ছেলে। আমিও হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলাম। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে বেশি দূর এগোতে পারিনি। তাই দুস্থ খেলোয়াড়দের ওপর সরকারের নজর দেওয়া উচিত, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। আমার মতো দরিদ্রতার কারণে কারও স্বপ্ন যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা উচিত। তাহলে ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। আমার তো এখন বয়স শেষ। এখন আমি আমার সন্তান কে মাঠে আনার চেষ্টা করছি। বর্তমানে অনলাইন গেম ও মাদকের করালগ্রাসে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমার আবেদন যুবসমাজকে বাঁচানোর জন্য মাঠে খেলাধুলা হোক। তরুণ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত মাঠের ব্যবস্থা করা হোক।
রাজবাড়ী জেলা টিমের সাবেক ফুটবলার শাহিন বলেন, বিনয় আমার জুনিয়র হলেও আমরা একসঙ্গে খেলেছি। সে ভালো খেলতো। কিন্তু সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বেশি দূর এগোতে পারেনি। বর্তমানে এখন যারা ফুটবল খেলে বেশির ভাগই গরিব ঘরের ছেলে। সরকার যদি আর্থিক সহায়তা ও এদের প্রতি সুনজর দিতো তাহলে রাজবাড়ীতে অনেক ভালো মানের খেলোয়াড় তৈরী হবে।
বিনয়ের স্ত্রী অপরূপা সাহা বলেন, বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি ফুটবলের প্রতি আমার স্বামীর ভালোবাসা। ফুটবল ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সে বিভিন্ন জায়গায় খেলাধুলা করত। আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলবে। কিন্তু খেলতে গিয়ে হঠাৎ তার পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারায় এবং সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিবারের দরিদ্রতার কারণে সে ফুটবল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি।
বিনয়ের বড় ভাই নির্মল কুমার সাহা বলেন, আমার ছোট ভাই বিনয়ের ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। ছোট বেলায় বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলত। এজন্য বাবা-মায়ের কাছে অনেক বকাও শুনেছে। বিনয় স্কুল, কলেজসহ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলেছে। কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটন ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সে বেশি দূর এগোতে পারেনি। আমাদের স্বপ্ন ছিল সে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে, দেশের জন্য কিছু করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
রাজবাড়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো: শফিকুল ইসলাম শফি বাংলানিউজকে বলেন, বিনয় ভালো খেলোয়াড় ছিল। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারায় সে বল নিয়ে আর মাঠে নামতে পারেনি। শেষ হয়ে যায় তার ভালো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। একজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের সুস্থতার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে জেলা পর্যায়ে মানুষ সর্বোচ্চ আবেগ দিয়ে খেলবেন। দারিদ্রতার কারণে কোনো খেলোয়াড়ের স্বপ্ন যেন হারিয়ে না যায় সেই প্রত্যাশা জেলার সকল ফুটবল প্রেমীদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২৩
এএইচএস