সমুদ্রবেষ্টিত মুম্বাইয়ের মুগ্ধতার কিছু অংশ প্রথম পর্বে আপনাদের কাছে তুলে ধারার চেষ্টা ছিল। আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বাকিটা তুলে ধরলাম দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ডে।
বাড়ে মিয়ার শিক কাবাব
১৯৫৪ সালে উত্তর প্রদেশের এক ছোট গ্রাম থেকে তৎকালীন বোম্বাই শহরে আসেন ১৩ বছরের মোহাম্মাদ ইয়াসিন। কষাই হিসেবে কাজ শুরু করতে করতে রন্ধনশিল্পে আগ্রহ জন্মে তার। ধর্মগুরু মোহাম্মদ আদম চিশতীর থেকে ২০ রুপি নিয়ে নাভাল পোর্টের কাছে নৈশকালীন খাবারের দোকান খুলে বসেন তিনি। তার হাত ধরেই ক্রমশ শহরে শিক কাবাবের জনপ্রিয় বাড়তে থাকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউড স্টার, ক্রিকেটার থেকে সাধারণ শহরবাসী, কে নেই যে এই কাবাবের স্বাদে মাতেনি। বলিউডের এ শহরে এসে বাড়ে মিয়ার শিক কাবাব চেখে দেখা মুম্বাই শহরের অন্যতম ‘থিংস টু ডু’।
আমি বাংলাদেশি শুনে গর্বভরে রেস্তোরার লোকেরা জানালো, এখানে নাকি ঢালিউড খলনায়ক ডিপজল ভাইও খেয়ে গিয়েছেন!
শাহরুখ-সালমান-অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি দর্শন
সিনেমার শহর মুম্বাইয়ের সবচেয়ে বড় তারকা অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান ও শাহরুখ খান। এদের বাড়ির গেটের সামনে ছবি তুলতে দেশ বিদেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা। শাহরুখ খানের প্রাসাদসম বাড়ি ‘মান্নাত’-এর লোকেশন বান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ড এলাকা, সালমান খানের অ্যাপার্টমেন্ট গ্যালাক্সিও একই এলাকায় অবস্থিত। আর অমিতাভ বচ্চনের দুটি বাড়ি প্রতীক্ষা এবং জলসার অবস্থান মুম্বাইয়ের জুহু এলাকায়।
ইরানি-পার্সি রেস্তোরায় ভোজন
মুম্বাই শহরের ভোজন ঐতিহ্যের অন্যতম অংশীদার এখানকার ইরানি এবং পার্সি রেস্তোরাগুলো। লোকবিশ্বাস অনুসারে প্রায় ১ হাজার বছর আগে ইরান থেকে পশ্চিম ভারত, প্রধানত মুম্বাইয়ে এসেছিল পার্সিরা। সে থেকেই এদের রন্ধনশৈলী মুম্বাইবাসীর অন্যতম প্রধান রসনার অংশ। ব্রিটানিয়া অ্যান্ড কোম্পানি রেস্তোরা, কায়ানি অ্যান্ড কো, ইয়াজদানি বেকারি, পার্সিয়ান দরবার, ইরানি চায়ে ইত্যাদি মুম্বাইয়ের প্রধানতম সব পার্সি রেস্তোরার নাম। ইরানি চায়ে রেস্তোরার মালিক মনসুর সোওঘি ইয়াজদির সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রেস্তোরাটিতে একদিন মধ্যাহ্নভোজের। মুগ্ধ হয়েছি ইরানের চা-এর ব্যতিক্রমী স্বাদে এবং রেস্তোরার লোকজনের আতিথেয়তায়।
বড়া পাও-পাও ভাজি-মিশাল পাও
মহারাষ্ট্রের মারাঠি মানুষদের প্রিয় স্ট্রিট ফুড আইটেমের তালিকায় সবার উপরে থাকবে যেসব নাম তা হলো বড়া পাও, পাও ভাজি এবং মিশাল পাও। এসব আইটেমে একটি জিনিস কমন, আর তা হলো বনরুটি। মহারাষ্ট্রবাসীর বনরুটিপ্রিয়তার কথা বিশ্বব্যাপী জানে। সকাল কিংবা বিকেলের নাস্তায় এখানকার মানুষ ঝটপট যেটা খেয়ে খিদা মেটায় তার নাম বড়া পাও (Vada Pav)। ছোট বনরুটির মাঝে অপেক্ষাকৃত বড় আলুর চপ, পুদিনা-টমেটো চাটনি দিয়ে পাশে কাঁচা মরিচ রেখে দিন, হয়ে গেল বড়া পাও। অনেকে এটিকে বোম্বে বার্গারও বলে থাকে। পাও ভাজিতে বনরুটির সঙ্গে থাকে একপ্রকারের ভাজি, আর মিশাল পাও এ পাঁচমিশালি ভাজির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় চানাচুর।
প্রেক্ষাগৃহে বলিউড চলচ্চিত্র দর্শন
বলিউডের শহরে এসে প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমা না দেখলে ব্যাপারটা কি জমে বলুন? এই শহরে যেমন আছে সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমাহল, তেমনি আছে মাল্টিপ্লেক্সও। রিগ্যাল ও লিবার্টি সিনেমা হল মুম্বাই শহরের জনপ্রিয় দুটি সিঙ্গেল স্ক্রিন হলের নাম। অপরদিকে আইনক্স, পিভিআর প্রভৃতি শহরের বড় সব মাল্টিপ্লেক্সের নাম। মজার ব্যাপার হলো ভারতের সিনেমা ইতিহাসে অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র শাহরুখ-কাজল অভিনীত ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-এর একটি শো প্রায় পঁচিশ বছরের অধিক সময় ধরে প্রতিদিন মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়ে থাকে, যেটির দর্শনও হতে পারে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।
পুনশ্চ, সিনেমার মতো সত্যিকারের মুম্বাইয়ের চা-ওয়ালারা ইংরেজি বলতে পারেন না! এমন কী ইংরেজি বুঝতেও পারেন না। সবখানে মারাঠি কিংবা হিন্দি চলে। সিনেমা মানেই ফাঁকি, ভুল সবই ভুল!
শহরে ঠিকঠাকভাবে চলাচলের জন্য তাই হিন্দি ভাষা বোঝা কিংবা বলতে পারার দক্ষতা এক ধরনের বাধ্যতামূলক। স্যাটেলাইটের যুগে সেটি বোধকরি খুব একটা কঠিন কাজ নয়। প্রায় সপ্তাহ অধিক সফর শেষে দেশে ফিরতে ফিরতে মন বলছিল, আবারও শিগগিরই কখনো ফিরব এ শহরে, মেরিন ড্রাইভে পড়ন্ত বিকেলের সেই সুন্দর সূর্যাস্ত দেখতে আর বাড়ে মিয়ার শিক কাবাব খেতে…।
আরও পড়ুন: মুম্বাই ডায়েরি: বলিউড আর সমুদ্রের শহরনামা (পর্ব ১)
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০২১
জেআইএম