ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-৭)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-৭) নভেরা হোসেন

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার।


সোবাহান, ফেন্সি জুয়েল ও বড় রানা ওদের তিনজনের বিরুদ্ধেই মূল মামলা। আর কিছু অজ্ঞাতপরিচয়, নাম দেওয়া হয় নাই। এমন ফেরারি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না ওদের। কিন্তু কিছু করার নেই শক্ত মামলা হয়েছে। ধরা পড়লে অনেক বছরের জেল-জরিমানা। এর আগেও দুবার সোবাহান মাল নিয়ে ধরা পড়েছিল, তখন এক বড় ভাই নেতা ওকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে। এই বড় ভাইরা না থাকলে জেলে পচে মরতে হতো। অবশ্য বড় ভাইরা যে টাকা খরচ করে ওকে ছাড়িয়ে আনে পরে তা পুষিয়ে নেয়। প্রত্যেক চালানে তাদের বখরা দিতে হয়। এভাবে দেওয়া-নেওয়ার সম্বন্ধটা সোবাহানকে এই লাইনে টিকিয়ে রাখে।

কিন্তু এবার খুনের আর হয়রানির মামলা। বাড়ি লুটপাটের সাথে ড্রাগসের এমন কঠিন মামলা দিয়েছে সোবাহানের প্রতিপক্ষ খবির যা থেকে নিস্তার নাই। খবির অনেকদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিল। এইবার সে সুযোগ পেয়ে যায়। বাবলুর বাবাকে দিয়ে সোবাহানের নামে মামলা দিয়ে দেয়। বাবলুর বাবা এতো মামলা-মোকদ্দমায় যেতে চাইছিল না সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করতে চেয়েছিল। খবির টাকার বিনিময়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে বাবলুর বাবাকে দিয়ে এই মামলা দেওয়ায়। সোবাহানকে এই মামলায় কেউ সাহায্য করতে চাইছে না। সোবাহান চেনা-জানা সব বড় ভাইদের ফোন করে, সবাই একই কথা বলে। শুধু ড্রাগের মামলা হলে কোনো ব্যাপার না কিন্তু এটাতো প্রায় খুনের মামলা, হয়রানি, অন্যের বাড়িতে জুলুম, ভাঙচুর, তাদের ছেলের বিয়ে ভেঙে দিয়ে মেয়েকে তুলে আনা। এসব কেসে বড় ভাইরা সোবাহানকে সাহায্য করতে পারবে না সাফ জানিয়ে দেয়। সোবাহান অনেক অনুরোধ করে কিন্তু কেউ ওর সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেউ একটা উকিল রাখার ব্যবস্থা বা জামিনের কথা বলে না। সবাই বলে লুকিয়ে থাকতে। কয়েক বছর গেলে মামলা ধামা-চাপা পড়ে যাবে।

সোবাহান ওর ছেলেপেলেদের লাগিয়ে রাখে খবরের জন্য। পরিচিত সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়, বাড়িতেও যায় না। বাড়ির সামনে দোকানে গুপ্তচর লাগানো আছে। কিছু  জমানো টাকা ছিল সেগুলো নিয়ে এক ছোটখাটো নেতাকে দেয় সোবাহান, নেতা বলে সে দেখবে মামলা ঘোরানো যায় কি-না,  কিন্তু আরও টাকা লাগবে। সোবাহান হতোদ্যম  হয়ে পড়ে। ওর যেমন অনেক চর আছে মহল্লায় মহল্লায়, তেমন পুলিশেরও অনেক চর আছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। চকবাজারের খবির ব্যবসায় সোবাহানের প্রতিপক্ষ।  তার লোকজন জালের মতো ছড়ানো সব এলাকায়। সোবাহান যত সাবধানেই থাকে খবিরের কাছে কোনো না কোনো খবর পৌঁছে যায়। দুইবার বুড়িগঙ্গায় একটুর জন্য বেঁচে যায়।

সোবাহান এই দুঃসময়ে শাবানকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। বারবার শাবানের মুখ ভেসে ওঠে মনে। সাহস করে একদিন মামুদদের বাড়িতে যায় মিরপুরে। দুপুর বেলা মামুদ তখন বাসায় ছিল না, শাবানের বাবা ঘুমিয়ে। সোবাহান ঘরে ঢুকে রোজাকে দেখতে পায়, শাবান রান্না করছে।
শাবান সামনে আসতেই সোবাহান খুব আবেগতাড়িত হয়ে পরে।
কেমন আছো তুমি?
ভালো, আপনাকে এমন দেখাইতেছে কেন?
আমি ভালো নাই শাবান।
হুম ভাইয়ের কাছে সব শুনছি, এইখানে আসা আপনার ঠিক হয় নাই, কেউ যদি খবর দিয়া দেয়।
আমি আর থাকতে না পাইরা আসছি, তোমার জন্য খুব খারাপ লাগতেছিল।
সোবাহান শাবানের হাতটা ধরে বলে আমারে একটা কথা দিবা তুমি?
বলেন।
আমারে কোনো দিন ছাইড়া যাইও না।
শাবান চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তুমি জানো না আমার বুকের মধ্যে তোমার জন্য কী হয়, ভালো-মন্দ যাই হোক আমার জন্য অপেক্ষা কইর। এই বিপদ কাইট্যা যাবে, এরপর আমি এই কাজ ছাইড়া দিমু শাবান, তোমাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চইলা যামু।
শাবানের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
সোবাহান শাবানকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে থাকে।
ভেতর থেকে মামুদের বাবা বলে কী হইছে শাবান? কে আইছে? কে কাঁন্দে?
সোবাহান শাবানকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
আপনি বসেন আমি আপনার জন্য মালাইয়ের চা আনতেছি।
না শাবান আমার সময় নাই।
এই যাব আর আসব।
মামুদ কই?
বাজারে গেছে।
শাবান মালাইয়ের চা নিয়ে ফেরার পথে দেখে সারা বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। শাবানকে ঘরে যেতে দেয় না। রোজা, মহররম ভেতরে কান্না শুরু করে। খবর পেয়ে মামুদ ছুটে আসে।

পুলিশ সোবাহান আর মামুদকে ধরে নিয়ে যায়। ভয়ে শাবান কাঁপতে থাকে, ছোট দুই বোনকে নিয়ে মিরপুর এক নম্বরে শিয়ালবাড়িতে ছোট মামার বাসায় চলে যায়। সোবাহানের গ্রেফতারের ঘটনায় পুরো লালবাগ এলাকা একদম থ মেরে যায়। ওকে পুলিশ ধরতে পারবে কেউ চিন্তা করে নাই। এলাকার রাজনৈতিক নেতা, বড়ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের সাথে ওর জানাশোনা, তাদের বখরা দিয়েই সোবাহান কাজ করে কিন্তু খবির কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করলো কেউ ভেবে পায় না।

সোবাহানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায়ই পুলিশ এসে বাসা তছনছ করে, টাকা-পয়সা খোঁজে। লালু শেখ বলে, আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নাই ভাই, ওই ছেলে আমারে কোনোদিন টাকা-পয়সা দেয় নাই। ওর দোস্তদের ধরেন তারা বলতে পারবে। পুলিশ লালু শেখকে হুমকি দিয়ে যায়, ছেলের কোনো মালামাল যদি ঘরে পাওয়া যায় তাহলে তাকেও বেঁধে নিয়ে যাবে থানায়। লালু শেখ লাইলীর জন্য ভয় পায়, পুলিশ যদি মেয়ের কোনো ক্ষতি করে।

লালু শেখ ঘরের দরজায় বসে রোদ পোহায় আর প্যাচাল পাড়তে থাকে।
ওই রে বেজন্মা পোলা তোরে কত কইছি এই কাম করিসনা। বাপ-দাদার সারেংয়ের কাম কর নাহলে একটা ভালো দোকান কর চকবাজারে। শুনলি আমার কথা? এখন জেলের মধ্যে পইচা মর। আমি লালুশেখ তোরে ছাড়াই আনতে পারুম না, হেই ক্ষেমতাও আমার নাই। মা মরলো আর তুই সংসারে এমন আগুন দিলি? লালু শেখ চিৎকার করতে থাকে আর পুরনো আমলের সিন্দুক খুলে এটা সেটা দেখে। এক জোড়া মুক্তার দুল, খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল। দাদির এটাই শেষ সম্বল, বের করে লাইলীর হাতে দেয়। যা এইটা বেইচা বাজার-সদাই কর গিয়া।

লাইলী হাত পেতে দুলটা নেয় বাবার কাছ থেকে। কী সুন্দর মুক্তার দুল। বড় গোলাপি মুক্তার চারপাশে সোনা দিয়ে মীনা করা। একটা ঝালর ঝুলানো নিচের দিকে, ঝালরে ছোট গোলাপি পাথর লাগানো।

লালু শেখ এই দুল কোনোদিন কাউকে ধরতে দেয় নাই, এমনকি নিজের স্ত্রীকেও না। নিজের দাদির মতো কাউকে মনে হয় নাই, সবাইকে নিচু জাতের মনে করেছে, আজ সেই দুল লাইলীর হাতে দিল, ওর চোখ ফেটে কান্না আসতে থাকে। দুল দুটো রান্না ঘরে ডালের কৌটার মধ্যে ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে রেখে লাইলী ঘর থেকে বের হয়।

বকশিবাজারে রোখসানার বাসায় যায়। রোখসানা চাকরি করে কিন্তু কী চাকরি লাইলী জানে না। শুনেছে ভালো কাজ না, কিন্তু আজ ওর উপায় নাই, রোখসানা ছাড়া আর কার কাছে যাবে? রোখসানা অনেক সময় লাইলীকে বলেছে, তুই যদি কাজে আসিস তাহলে আমাগো আর ভাত থাকব না। ওর সাথে স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে লাইলী, তারপর আর পড়ালেখা হয় নাই। পাড়ার বখাটে ছেলেরা বিরক্ত করে দেখে লালু শেখ মেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দেয়। রোখসানা ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। তারপর কাজে ঢোকে। এখন আয়-রোজগার ভালো। ঈদ, কোরবানিতে লাইলী রোখসানার বাড়িতে যায়। দুই বান্ধবী মিলে অনেক গল্প করে, সুখ-দুঃখের আলাপ করে। বাবলুর সাথে লাইলীকে রোখসানাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
কিরে লাইলী, এতদিনে বান্ধবীর কথা মনে পড়লো?
মনেতো পড়ে কিন্তু শুনছোসতো সব। ভাইজানরে পুলিশ ধইরা নিয়া গেছে, বাবলুর বাপ এই মামলা দিছে। খবির হারামজাদা বাবলুর বাপেরে দিয়া সব করাইছে।
শুনছি সব। সোবাহান ভাই যে কাম করে সেখানে অনেক বিপদ ওত পেতে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু তোরে নিয়ে সে বাড়াবাড়ি করল। কী দরকার ছিল বাবলুরে পেটানোর? আজ এতো বড় বিপদ আসল।

ভাইজানের সবসময় মাথা গরম। আমারে ঐখানে দেইখা মাথা ঠিক রাখতে পারে নাই। এই ঘটনা আমার মনে যে কত কষ্টের কারণ হইছে তা বোঝার সাধ্য তার নাই, আফসোস নিজের ভাই হইয়া আমারে কষ্ট দিল।
কী করবি এইসব ঘটনা কারও হাতে থাকে না। তুই এমন একটা কাজ করলি, আমারেও জানাইলি না।
তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। বাবলুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে ওর জন্য পাগল হইয়া গেছিলাম। বাবলুর সাথে বিয়েতে ভাইজান কোনোদিন রাজি হইতো না। ওর একটা পা ছোট, এইটা কেউ মাইনা নিতো না।
তুই তোর বাপ-ভাইদের কাছে বাবলুর কথা কইয়া দেখতে পারতি।
কী জানি রোখসানা আমার তখন সবকিছু এলোমেলো হইয়া গেল। বাবলু একদিন আমারে কইল চলো আমরা নানাবাড়ি যাই, ওইখানে নানারা আমাদের বিয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি রাজি হইয়া গেলাম। ভাবি নাই ভাইজান খবর পাইয়া যাবে।
যাই হোক এখন আর বাবলুর কথা ভাইবা কী লাভ?
হুম সত্যি। খুব কষ্ট হয়, মাইনা নিতে পারি না। ওই ঘটনার পর বাবলু যেন আমারে চেনেই না। কতবার ফোন করছি, লাইন কাইট্যা দেয়। এখন ফোন বন্ধ পাই, মনে হয় সিম বদলাইছে।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]

আরও পড়ুন>>
লালবাগ (পর্ব-৬)
লালবাগ (পর্ব-৫)
লালবাগ (পর্ব-৪)
লালবাগ (পর্ব-৩)
লালবাগ (পর্ব-২)
লালবাগ (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
টিএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।