সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
৮
কী করবি লাইলী কপাল। রোখসানা নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, এইখানে না থাকলে কিছুই পাওয়া যায় না। তোদের মধ্যে কত ভাব-ভালোবাসা, মিল-মহব্বত। কিন্তু বাবলু বাপের বিরুদ্ধে গিয়া এই বিপদে তোর পাশে দাঁড়াবে? জীবনেও না। অরওতো জীবনের ডর আছে। সোবাহান ভাই যখন বাবলুরে মাইরা তক্তা বানাইছে সেই সময়েই ও তোর নাম নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলছে। তুই বাবলুরে ভুইলা যা।
লাইলী রোখসানার কথা শোনে আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে রাখে। ওর সারা মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে ওঠে।
বাদ দে এখন বাবলুর আলাপ। সোবাহান ভাইকে ছাড়ানোর জন্য কিছু করবি না?
আমি কী করমু বল? কাউরে চিনি? সবাই এখন গা ঢাকা দিছে। জুয়েল, রানা সব পলাইছে। সবার ফোন বন্ধ। কেউ এখন আমাগো বাড়ির দিকে চুপি পর্যন্ত দেয় না। শুনছি ভাইজানের অনেক বড় বড় লোকের সাথে চিন-পরিচয় কিন্তু হেরাতো কিছু করতাছে না।
মাঝে মাঝে পুলিশ আইসা বাসা তছনছ করে। আব্বারে, আমারে ভয় দেখায়। কয়, শোন ছেমরি সোবাহানের দল-বল সব কই? ওর মাল সব কোথায় লুকানো আছে, টাকা পয়সা? সব বল, নাহলে বাপরেসহ তোরে চালান দিয়া দিমু।
ভয়ে আমার জান শুকিয়ে যায়। ঘরে তেমন টাকা-পয়সা নাই। ভালো কইরা বাজার-সদাই করতে পারতেছি না। আজ আব্বা তার দাদির মুক্তার দুল বিক্রি করতে দিছে।
কোন দুল? ওই যে গোলাপি মুক্তার দুলজোড়া?
হ, নুরজাহান বিবির।
ঐটাতো খুব সুন্দর, অনেক খানদানি মাল। ঐটা হাতছাড়া করিস না। তোদের বংশের চিহ্ন। একবার হাতছাড়া হইলে আর ফেরত পাবি না। বাবলু যেমন হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে ওই দুলটাও চলে যাবে।
আর দুল! বাবলুই আমারে ভুইলা গেলো, ভাইজান জেলে। দুল দিয়া কী করমু? পেটে ভাত না থাকলে কোনো কিছুই কিছু না।
শোন লাইলী তুই যেহেতু এই বিপদে আমার কাছে আইছস। আপনজন মনে কইরা তোরে একটা কথা বলি। তুই আমার লাইনে চলে আয়। তোরতো ভাইরে ছাড়ান লাগবো, বাপরে খাওয়ান লাগবো। চুপ কইরা হাত-পা গুটাইয়া বইসা থাকলে চলবে?
তুই কী কাজ করিস? শুনছি ভালো কাম না।
হ ভালো কাম না, কোন সুমুন্দির পুত কইছে? তারা তোরে একটা টাকা দিয়া দেখব? তোরে ভাত দিব? এই যে তোর ভাইটা জেলে পইচা মরতাছে কোনো বাপের বেটা তারে ছাড়াইয়া আনব?
কে যাইব বল? এতদিন যাদের জন্য কাম করছে সব পলাইছে। বড় ভাইরা কেউ ওর নাম পর্যন্ত নেয় না। এইসব মামলা খুব কঠিন। ভাইর অনেক বছর জেল হইয়া যাইব। খুনের মামলাও দিছে। সব করছে চকবাজারের খবির মাস্তান। ভাইরে ব্যবসা থেকে সরাইতে চাইছে। বাবলুরে ঘুটি হিসাবে ব্যবহার করছে।
বুঝলমতো সবই, কিন্তু তুই কী করবি ঠিক কর, আমার সাথে কাজ করবি?
ভাইবা দেখি। তোর যে লাইন একবার ঢুকলে আর কোনোদিন ফিরা আসতে পারুম?
ফিরা আসার দরকার কী? তুই যদি খাইয়া-পইড়া ভালো থাকিস তাহলে এই লাইনেই থাকবি। নাকি এখনও বাবলুর চিন্তা করতেছিস?
না না বাবলুর কী চিন্তা করমু? তবে ওরে আমি ভুলতে পারুম না। আমার মনের মধ্যে বাবলু থাকবে সারাজীবন।
থাকলে থাকবে তাতে কী? আচ্ছা ভাইবা আমারে জানাবি। কালকেই জানাইস, তোরে নিয়া যামু।
রোখসানাকে নিয়ে লাইলী পুরান ঢাকায় জেলখানায় যায়। চারদিকে লোকজন, কাদাপানি, পুলিশ একদম নরক। একজন দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে রোখসানা জেল-হাজতে লাইলীর সাথে সোবাহানের দেখা করার সুযোগ করে দেয়। গরাদের বাইরে দাঁড়িয়ে লাইলী দেখে এই কয়দিনেই সোবাহানের চেহারা ভেঙে গেছে। হাতে, চোখে-মুখে মারের চিহ্ন। শুকিয়ে গেছে, ভাইকে দেখে লাইলী কান্না শুরু করে।
পুলিশ বলে একদম চুপ, কোনো শব্দ করবি না। চুপচাপ ভাইরে দেইখা চইলা যা।
সোবাহান লাইলীর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। গার্ড সেটা দেখে বলে, দেখি কী কাগজ? এইখান থেকে একটা খবরও বাইরে যাবে না।
লাইলী কাগজটা মেলে ধরে। দুইটা ফোন নম্বর লেখা। পুলিশ এ জন্য আরও এক হাজার টাকা দাবি করে। রোখসানা টাকা দিয়ে লাইলীকে নিয়ে বাইরে আসে। ভেতরে পচা একটা বোটকা গন্ধ, লাইলীর গা গুলিয়ে ওঠে।
জেল-হাজত থেকে দুজনে লালবাগের বাসায় আসে, লাইলীর হাতে রোখসানা এক হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে কাল আমারে জানাবি তোর মতামত কাজ করবি কি-না।
ঘরে চল।
না আজকে যাব না, লালবাগে একটা কাজ আছে, একজনের কাছে টাকা পামু. ওইটা নিয়া বাসায় যাব, তুই আমাকে জানাইস কী চিন্তা করলি।
লাইলী শুকনো মুখে ঘরে ঢোকে। লালু শেখ বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে, দুপুরের খাওয়া হয় নাই। দৌড়ে দোকান থেকে চাল, ডিম, তেল কিছু মসলা কিনে এনে রান্না চড়ায়।
লাইলীর শব্দ শুনে লালু শেখ জেগে ওঠে।
কীরে লাইলী মুক্তার দুলটা নিয়া কই গায়েব হইয়া গেলি? সারাদিন পার করলি, খিদায় পেট জ্বলতাছে, সকালের পর পেটে কিছু পরে নাই। হাঁটুর বেদনাটা আবার বাড়ছে। শেষে বেদনার ট্যাবলেট খাইয়া ঘুমাইছি।
আমি ভাইজানরে দেখতে গেছিলাম।
কী কামে?
আব্বা এইটা তুমি কী কইলা? ভাইজানরে ছাড়াইয়া আনতে হবে না?
তুই কেমনে ছাড়াবি? আমাগো কী লক্ষ লক্ষ টাকা আছে? তর ভাইতো ফেন্সির ব্যবসা কইরা পাই-পয়সা জমায় নাই। টাকা-পয়সা কী করছে এতদিন কে জানে? শুনতেছি কত লোক তার কাছে টাকা পায়।
আব্বা শোনা কথায় কান দিয়েন না। ড্রাগের বিজনেস করলে সবাই শত্রু হইয়া যায়, কেউ একটা ভালো কথা কয় না। মনে হয় কেউ ড্রাগ খায় না, হারামির বাচ্চারা। সবাই ফেরেস্তা আর আমরা খারাপ লোক! দোজগে যামু, যা তোদের বিচার আল্লায় করবে।
চুপ কর লাইলী, মুখ খারাপ করিস না। ভাইর জন্য এতো দরদ তাইলে কেন গেলি ওই পোলার লগে? সবকিছু তো আজ তোর জন্যই হইছে। তুই চেনোছ না নিজের ভাইরে?
লাইলী গরমের মধ্যে ভাত নামিয়ে চুলায় ডাল চড়ায়। আর ভেতরে ভেতরে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে।
কী তোর রান্না হইছে?
এইতো ডাল বাগাড় দিয়া ডিম ভাইজা দিতেছি।
জলদি কর। কেন মাছ-মাংস কিছু আনোছ নাই?
না। ভাইজানরে দেখতে গেছি জেলখানায় টাকা-পয়সা খরচ হইছে। টাকা রাইখা দিছি, চলতে হবে না? এখন মাছ-মাংস খাইলে হবে?
লাইলী বাবার জন্য পোড়া মরিচ আর সর্ষের তেল দিয়ে ভর্তা করে। লালু শেখ ডিম ভাজি আর ডালের সাথে পোড়া মরিচ ডলে ডলে ভাত খায়।
ঝালে লালু শেখের চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।
লাইলীর ভাত খেতে ইচ্ছে করে না, মুড়ি পানি দিয়ে ভিজিয়ে খায়। সন্ধ্যার সময় গোসল করে একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে। সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। রোখসানার সাথে কাজে যাওয়ার কথা ভাবে আবার কী মনে হয়। ভাইজান যদি জানতে পারে, ওরে কাইট্যা নদীতে ভাসাইয়া দিবে।
ভোরবেলা উঠে লাইলী রোখসানাকে ফোন করে।
রোখসানা আমি কাজ করমু। কখন যাইতে হবে?
আচ্ছা আমি তোরে জানাইতেছি।
সকালে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে লাইলী তৈরী হয়। জর্জেটের একটা কামিজ আর চুন্দ্রি ওড়না পড়ে চুড়িদার সালোয়ারের সাথে। কানে, গলায় ইমিটিশনের গহনা, খুব উঁচু করে চুল বাঁধে, মুখে গাঢ় মেকআপ, লাল লিপস্টিক। আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারে না।
লালু শেখ ঘরের দরজায় বসে আছে।
আব্বা আমি একটা চাকরি পাইছি। এখন থেকে প্রায় দিন কামে যাইতে হবে। রান্না কইরা সব মিটসেফে রাইখা গেলাম, খাইয়া নিও।
কীসের চাকরি? কে দিলো? আগে তো শুনি নাই।
ওই আমার বান্ধবী রোখসানা দিছে, ওর অফিসে। ভালো টাকা-পয়সা দিবে। রাতে ওভার-টাইম করতে পারলে আরও ভালো টাকা।
রাইতে কাম? এইডা কী কাম? রাইতে কেন?
না আব্বা আমি রাইতে কাম করুম না, দিনে করুম।
কী জানি তুই হঠাৎ চাকরি নিলি, এইটা কী ঠিক হইল?
ভালো চাকরি আব্বা। চিন্তা কইরো না, আমাদের চলতে হবে না? ভাইজানরে জেল থেকে ছাড়াইতে হবে না? ঘরে বইসা থাইকা কী করুম?
তুই এতো সাজগোজ করছোস কেন?
ওহ, তারা ফিটফাট থাকা পছন্দ করে, যাই আমার দেরি হইয়া গেলো।
লাইলী রোখসানার বকশিবাজারের বাড়িতে যায়। রোখসানা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। লাইলীকে নিয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে। লাইলীর একটু ভয় লাগে। অজানা, অচেনা ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]
** আরও পড়ুন>>
লালবাগ (পর্ব-৭)
লালবাগ (পর্ব-৬)
লালবাগ (পর্ব-৫)
লালবাগ (পর্ব-৪)
লালবাগ (পর্ব-৩)
লালবাগ (পর্ব-২)
লালবাগ (পর্ব-১)
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০
টিএ