ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

নিয়ন্ত্রণ প্রভাবশালীদের, জেলেদের মাছ পানির দরে

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৪
নিয়ন্ত্রণ প্রভাবশালীদের, জেলেদের মাছ পানির দরে

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। শূন্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না, এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারেন না তারা। উপকূল ঘুরে জেলে জীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। সাত পর্বের ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব     

উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নেওয়া সব পদক্ষেপেই ভোগান্তি পোহাতে হয় জেলেদের। বছরের বিভিন্ন সময় নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। দিনের পর দিন অভিযান চলে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রে। মাছ ধরা বন্ধ থাকাকালীন সরকারের দেওয়া পুনর্বাসন সহায়তাও পৌঁছায় না জেলেদের ঘরে। জেলে পরিচয়পত্র প্রদানেও অনিয়ম। এতসব ঝক্কি পার করে মাছের মৌসুমে মাছ পেলেও জেলেদের সে মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দামে।

সরকারের মাছ ধরা নিষিদ্ধ কর্মসূচিতে মাছের উৎপাদন হয়তো কিছু বাড়ে, কিন্তু জেলেদের মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দরে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাছের উৎপাদন বাড়াতে কিংবা জেলেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও প্রকৃত জেলেরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। মাছধরা, মাছের দাম পাওয়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী চক্র।

ইলিশ আহরণের ক্ষেত্র মেঘনা তীরবর্তী এলাকা ঘুরে জানা গেছে, গত মৌসুমে এসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে। মেঘনা তীরের ছোট জেলেদের জালেও অনেক মাছ উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু বেশি মাছ পাওয়ার পরও জেলেদের মুখে হাসি ফোটেনি। নদী থেকে মাছ ধরে আনা জেলেদের কণ্ঠে তাই কষ্টের সুর। তারা বলেন, বেশি মাছ পড়লেও জেলেদের কোনো লাভ নাই। জেলেরা মাছ ধরলেও লাভবান হয় আড়তদাররাই।

উপকূলের জেলে অধ্যুষিত জেলা ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জেলেদের কাছ থেকেই পাওয়া যায় এমন তথ্য। মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের উদ্যোগের বিপক্ষে নন তারা, তবে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির অভিযোগ তাদের। জেলেরা জানালেন, যে মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হলেও তার বেশির ভাগই চলে যায় অ-মৎস্যজীবীদের কাছে। জেলেদের পরিচয়পত্র দেওয়া হলে, সে তালিকায়ও অ-মৎস্যজীবীরা ঢুকে পড়ছে।

সূত্র বলছে, জাটকা মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত রাখতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জেলেদের তালিকা তৈরি করা হয় পুনর্বাসনের জন্য। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। এদের প্রত্যেককে চার মাস অন্তর ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। তবে শতকরা ৫০ শতাংশ জেলেই এ সহায়তা পায় না। কারণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার তাদের ভোটে সমর্থক কর্মীদের নাম তালিকা অন্তর্ভূক্ত করে। এদের অধিকাংশই অ-মৎস্যজীবী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ ইতিবাচক। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে জেলেদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রকৃত জেলেদের তালিকা করা জরুরি। ভোলার দৌলতখান, লক্ষ্মীপুরের রামগতির স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পারে, জেলেদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে পরিচয়পত্র প্রদানেও রয়েছে নানা সমস্যা। প্রকৃত জেলেদের অনেকে এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, ফাঁকে ডুকে পড়েছে অ-মৎস্যজীবীরা।

জানা গেছে, উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি বৈঠক করে জেলে সনাক্তকরণের দায়িত্ব দেয় শিক্ষকদের। ওই বৈঠকে জেলে প্রতিনিধির কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। প্রতিটি ইউনিয়নে ৩-৪জন করে শিক্ষক জেলেদের তালিকা তৈরির কাজ করে। শিক্ষকেরা তাদের সুবিধামত সময়ে বাড়িতে কিংবা দোকানে বসে তালিকা তৈরি করে। অথচ নির্দেশ ছিল জেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা তৈরি করার।

জেলে তালিকা ধরে বিভিন্ন মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতারা দেখিয়েছেন, মাছ-জাল-নদী চেনেন না এমন অনেকেই জেলে তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। কৃষিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দোকানদার, স্‌-মিলের কর্মী, ইউপি মেম্বারের কর্মী, শিক্ষকদের আত্মীয়-স্বজন এই তালিকায় রয়েছেন।

ভোলার দৌলতখানে পরিচয়পত্র প্রদানের তালিকা তৈরিতে অনিয়ম প্রসঙ্গে মৎস্যজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হলে তিনি বলেছেন যা হবার তা হয়ে গেছে। কিছু করার নেই। তবে ভোলা জেলা প্রশাসক অ-মৎস্যজীবীদের তালিকা বাদ দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আদেশও দিয়েছেন। তারপরও কাজ হয়নি।

ভোলা জেলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, এক শ্রেণির অ-মৎস্যজীবী দাদনদার ও জলমহালের দখলদার প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ আহরণে বাধার সৃষ্টি করছে। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক দাবি-দাওয়ার পর জেলেদের পরিচয়পত্র দেওয়া হলেও ভূয়া মৎস্যজীবী ব্যক্তিরা তালিকাভুক্ত হয়েছে। সে কারণে এই পরিচয়পত্র দিয়ে জেলেদের অধিকার নিশ্চিত হবে না।

জেলেসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, জেলেদের একটি বড় অংশ চরম দরিদ্রতায় দিন কাটায়। মাছ ধরতে তারা প্রতিনিয়ত প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি থাকে। ধরে আনা মাছ বেচাকেনা থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রেও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই প্রভাবশালীরা গায়ের জোরে নিজেদের লোক দিয়ে খুটাজাল, নেট খরচি জাল, মশারি জাল, বিহুন্দি জাল, বেড় জাল দিয়ে মাছ ধরে।

এসব জালে ২-৩ ইঞ্চি থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত ইলিশের বাচ্চা, পোয়া, পাঙ্গাস, আইর, শিলমসহ সব ধরনের ছোট মাছ উঠে আসছে। ভোগান্তিতে পড়ছে জেলেরা।

এইসব অভিযোগ প্রসঙ্গে দৌলতখান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রমণী কুমার মিস্ত্রি বাংলানিউজকে বলেন, জেলেদের অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়। তাদের সুযোগ বাড়াতেই মাছের উৎপাদন বাড়াতে এসব উদ্যোগ। ‘জাটকা নিধন নিষিদ্ধ’ কর্মসূচির সুফল জেলেরাও পাচ্ছে।  
      
সিরিজের পরবর্তী পর্ব সমূহ
চার: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই পেশায়, অবস্থা বদলায় না
পাঁচ: জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন
ছয়: বিধবা জেলে বধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার
সাত: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি 

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।