ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী, কেবল নামেই উপজেলা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪
যোগাযোগবিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী, কেবল নামেই উপজেলা!

বাহের চর, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে: এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা, চব্বিশ ঘন্টার পথ। দেশের এমন এক উপজেলা সদর, যেখানে রাজধানী ঢাকা থেকে পৌঁছাতে এই দীর্ঘ সময় লঞ্চেই বসে থাকতে হয়।

মেঘনা, তেতুলিয়া, দাঁড়চিরা, আগুনমুখাসহ বেশ কয়েকটি নদী পেরিয়ে লঞ্চ পৌঁছায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে থাকা বিচ্ছিন্ন জনপদ রাঙ্গাবালীতে।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রেই পড়ছে এই বিচ্ছিন্নতার প্রভাব। রাজধানী ঢাকা তো দূরের কথা, জেলা সদর কিংবা পাশের উপজেলা সদরে যেতেও ঘন্টার পর ঘণ্টা লঞ্চ-ট্রলারের অপেক্ষা করতে হয়। একমাত্র যোগাযোগ সংকটই গোটা এলাকাকে উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত রাখছে, অসুখে উন্নত চিকিৎসাবঞ্চিত রাখছে। আধুনিক সব সেবা থেকেই বঞ্চিত থাকছে এখানকার মানুষ।   

যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: জয়নুল আবেদীন বলেন, এখন পর্যন্ত ট্রেজারি ব্যবস্থা চালুর অনুমতি না হওয়ায় ও সোনালী ব্যাংক না থাকায় কলাপাড়া গিয়ে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি বরাদ্দ উত্তোলন করতে হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় উপজেলার দপ্তরেরগুলোর দাপ্তরিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে।

উপজেলার বাসিন্দারা বলছেন, যোগাযোগের উন্নয়নের জন্য কোড়ালিয়া থেকে পানপট্টি লঞ্চঘাট ফেরি চালু হলে রাঙ্গাবালী সড়কপথে সংযুক্ত হবে। এর ফলে এখানকার মানুষের জীবনধারা বদলে যাবে। সরকারি অথবা বেসরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো হলে এখানকার অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের মানুষদের জীবন বাঁচাতে এখানে ৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে।

পটুয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে রাঙ্গাবালী কেবল নামেই উপজেলা। পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ যে পথেই যেতে হয় না কেন, নদীপথ ডিঙিয়েই যেতে হয়। পূর্বে তেঁতুলিয়া, উত্তরে আগুনমুখা, পশ্চিমে রামনাবাদ, দক্ষণেঁ বঙ্গোপসাগর।

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবহেলিত রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকে পটুয়াখালী জেলা সদরে যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। নেই কোনো সরকারি অথবা বেসরকারি বিদ্যুৎ। উচ্চ মাধ্যমিকের পর এখানে আর পড়ার সুযোগ নেই। উপজেলা হলেও দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকা অবহেলিত। জেলা শহর পটুয়াখালী থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাঙ্গাবালী উপজেলা।

এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী ২০১১ সালে থানাকে পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলায় উন্নীত করা হয় । কিন্তু তিন বছরেও এই উপজেলার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় নি। বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলা। স্থানীয় লোকজন আক্ষেপ করে বলেন, রাঙ্গাবালী কেবল নামেই উপজেলা। উপজেলার অনেক সুযোগ-সুবিধা এখানে আসে না।

রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, উপজেলা পর্যায়ে এখানকার অনেক পদই চলে অতিরিক্ত দায়িত্বে।   উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা,এসিল্যান্ড, সাব-রেজিস্ট্রি কর্মকর্তা, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পূর্ণকালীন কোনো কর্মকর্তা নেই। কলাপাড়া ও গলাচিপা উপজেলায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা এখানকার অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন।

উপজেলার দপ্তরগুলোর ভবন, আসবাবপত্র কিংবা জনবল নেই। সে কারণে অতিরিক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের কর্মস্থলে থেকেই রাঙ্গাবালীর দায়িত্ব পালন করছেন। একটিমাত্র ভবনে কোনো মতে চলছে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়, প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কার্যালয়ের কাজ।

সূত্র বলছে, উপজেলায় এখন পর্যন্ত ট্রেজারি ব্যবস্থা চালু হয় নি। এছাড়া রাঙ্গাবালীতে সোনালী ব্যাংক না থাকায় নদীপথে কলাপাড়া গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি বরাদ্দ উত্তোলন করতে হয়। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পোহাতে হয় নানান সমস্যা। এছাড়া উপজেলা ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন হয় নি।
 
উপজেলা প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় ৩৯১ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে পাকা রাস্তা মাত্র ৪১ কিলোমিটার। উপজেলার ভবনগুলো ও দুইটি ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় প্রকৌশল বিভাগের দাপ্তরিক কাজ করা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ছে। দপ্তরে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির পদ থাকলেও ৫টি পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন।

যোগাযোগ সংকট উপজেলাকে উন্নয়নে পিছিয়ে রাখছে বলে উল্লেখ করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, যোগাযোগ সংকটের কারণে এখানে বিদ্যুৎ নেই। আর বিদ্যুৎ না থাকায় দাপ্তরিক কাজ চালাতে হয় জেনারেটর দিয়ে। একটি ফটোকপি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দুর্যোগকালে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাঁচটি ইউনিয়নে দ্রুত চলাচলের জন্য স্পিডবোট প্রয়োজন থাকলেও তা এখানে নেই।

শিক্ষাক্ষেত্রেও যোগাযোগ সংকটের প্রভাব পড়েছে বলে দাবি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র হালদারের। তিনি জানান, যোগাযোগ সংকটের কারণে এখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হয় নি। শিক্ষা কার্যালয়ের ভবন না থাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।