ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বন্ধ্যাত্ব কাটছে না

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৪
স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বন্ধ্যাত্ব কাটছে না ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কুকরী মুকরী, চরফ্যাসন, ভোলা থেকে : দ্বীপচর কুকরী মুকরীর স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বন্ধ্যাত্ব কাটছে না কিছুতেই। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভবনের পাহারায় দেয়াল আর ফটক আছে ঠিকই; কিন্তু বিপন্ন মানুষের সেবায় সেখানে নেই চিকিৎসক।

কেন্দ্রের দশ জনবলের বিপরীতে আছে মাত্র চারজন। ফলে এই কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়াটাই কঠিন। নদী পার করে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার পথে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ।

অন্যদিকে দারিদ্র্যতার কারণে বহু ছেলেমেয়ে স্কুলের বাইরে থাকছে। আবার স্কুলগামীদের অনেকেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। অতিকষ্টে মাধ্যমিক পেরোলে পড়াশুনার জন্য যেতে হয় বাইরে। বহু ছেলেমেয়ের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায় সেখানে।

সরেজমিনে ঘুরে ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দ্বীপচর কুকরী মুকরীতে এই চিত্র পাওয়া যায়। সমুদ্রের নোনাজল বিধৌত আর বন বনানী বেষ্টিত এই চরের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে দরিদ্র মানুষেরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখানকার মানুষের ভরসাস্থল হলেও সেখানে কোনমতে প্রাথমিক চিকিৎসাটাই পাওয়া যায় না।

চরের প্রাণকেন্দ্র পুরান বাজার থেকে খানিক দূরে বাবুগঞ্জ গ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। ২০০৮ সালে এই কেন্দ্রটির ভবনটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সেই থেকেই কেন্দ্রটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কেন্দ্রের ক্লিনিক্যাল সেকশনের সর্বোচ্চ পদ উপসহকারি মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে আছেন কেন্দ্রের পদমর্যাদায় তৃতীয় ব্যক্তি ফার্মাসিস্ট আবদুর রহিম। পদমর্যাদায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এফডব্লিউভির পদও খালি।

অন্যদিকে নন ক্লিনিক্যাল সেকশনে তিনজন পরিবার কল্যাণ সহকারির মধ্যে আছেন মাত্র একজন। এমএলএসএস, নিরাপত্তা প্রহরী, ঝাড়–দার কিছুই নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকতেই চারদিকে চোখে পড়ে ময়লা-আবর্জনা। মেঝে খুব শিগগির ঝাড়– দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ফার্মাসিস্ট আবদুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এখানে এফডব্লিউভি পদ খালি। এজন্য প্রসূতি মায়েদের জটিল সমস্যায় চরফ্যাসনে রেফার করা হয়। তবে এই কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার সব ওষুধপত্র দেয়া হয়।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আশপাশের গ্রামবাসী, দোকানদার, টেম্পো চালকসহ অনেকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানালেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নির্মাণের আগে আমরা অনেক আশা করেছিলাম। চরের মানুষদের স্বাস্থ্য সংকটের দিন শেষ হবে। কিন্তু এখন দেখি কেন্দ্রটি নামেই আছে। এখানে কিছুই পাওয়া যায় না।

কুকরী মুকরীর সর্বদক্ষিণে মনুরা বাজারের ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানালেন, একবার তার ভাইয়ের হাতের সমস্যার জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। কোন কাজ হয়নি। পরে চরফ্যাসন, ভোলা, এবং বরিশালে চিকিৎসা নিয়েছেন। মোট খরচ ২৬ হাজার টাকার মধ্যে ওষুধ লেগেছে মাত্র চার হাজার টাকা। বাকি টাকা যাতায়াতে খরচ হয়েছে।

শাহবাজপুর গ্রামের আফিয়া বেগম বলেন, এই চরে বসে মুমূর্ষু রোগীদের ট্রলারে উঠিয়ে দিয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ভাগ্য ভালো থাকলে রোগী জীবিত অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পারে। পুরোটাই নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর।

চরের শিক্ষায় অচলাবস্থার কথা বলছিলেন আমিনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, পরিবারে দারিদ্র্যতা, অভিভাবকদের অশিক্ষা আর অসচেতনতাই শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। প্রথমত, প্রাথমিকের শেষ পর্যন্ত যেতেই অনেক শিশু ঝরে পড়ে, দ্বিতীয়ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে মাধ্যমিক পাসের পর অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়।

আমিনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতা দেখে প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, ওই বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ৭৫, প্রথম শ্রেণীতে ৫০, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৪০, তৃতীয় শ্রেণীতে ৩৪, চতুর্থ শ্রেণীতে ১৯ আর পঞ্চম শ্রেণীতে ২০জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এতে দেখা যায়, শিশু শ্রেণী থেকে ক্রমান্বয়ে উপরের শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে।

শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানালেন, এই বিদ্যালয়ের পাশেই একটি কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। এলাকার অধিকাংশ লোকজন ইসলামী মনোভাবাপন্ন হওয়ায় বিদ্যালয় থেকে নিয়ে সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করায় অভিভাবকেরা।

সরেজমিন ঘুরে চরের অন্যান্য এলাকায়ও হতাশাব্যঞ্জক শিক্ষাচিত্র চোখে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করেন না অভিভাকবেরা। স্কুলে লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল করলেও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যাওয়ার আগেই পরিবারের চাপে কাজে যোগ দিতে হয়।

চরের বিভিন্ন এলাকার ঘুরে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীতেই লেখাপড়া ছেড়ে দেয়া বহু শিশুর সঙ্গে দেখা মেলে। সবাই বলেছে, পরিবারে রোজগারের লোক নাই। তাই কাজ করতে হচ্ছে। এদের অনেকে আবার লেখাপড়া করতে নিজের প্রবল ইচ্ছার কথাও জানিয়েছে।         
 
বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।