ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জলের অবরোধ, জেলে জীবনে আকাল

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০১ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪
জলের অবরোধ, জেলে জীবনে আকাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কুকরী মুকরী, চরফ্যাশন, ভোলা থেকে: রাজপথের অবরোধ জেলেদের প্রভাবিত না করলেও সমুদ্র-নদীতে জলের অবরোধ তাদের জীবন ছুঁয়ে যায়।

মাছধরা নিষেধাজ্ঞার সময়টাকে জেলেরা বলে অবরোধ।

আর এই অবরোধের সময় জেলে জীবনে নেমে আসে অর্থ কষ্ট। ধার-দেনা করা, মহাজনের কাছে ধর্না দেওয়া, আগাম দাদন নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের।

সরেজমিন ঘুরে চোখে পড়ে, উপকূলের সমুদ্রপাড়ে জেগে থাকা ভোলার চরফ্যাশনের দ্বীপ কুকরী মুকরীর সব জেলেপল্লী, মৎস্য বন্দর ঝিমিয়ে আছে। আর এই সংকটের প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। হোটেল ব্যবসায়ী, কাপড়ের দোকানদার, চা বিক্রেতা, টেম্পো চালক, দিনমজুর সব পেশার মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে মাছধরা নিষেধাজ্ঞার এই অবরোধ। সবার মুখেই এক কথা, অবরোধ চলছে, দিন কাটছে ধুঁকে ধুঁকে।

কুকরী মুকরী দ্বীপের সর্ব দক্ষিণের গ্রাম নবীনগর। এই গ্রামের বাসিন্দা জেলে আশরাফ হাওলাদার বাংলানিউজকে জানান, অন্যের ট্রলারে মাছ ধরে জীবিকা চললেও প্রায় পাঁচ মাস ধরে কোনো কাজ নেই। মাছধরার কাজ বন্ধ থাকায় মাটিকাটাসহ অন্যান্য কাজে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন তারা। বিশ হাজার টাকা আগাম দাদন নিয়ে কোন মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

একই এলাকার আরেক জেলে আমীর হোসেন বলেন, কাজকর্ম বন্ধকালীন পাঁচ মাসে দেনা হয়েছেন প্রায় পনেরো হাজার টাকা। জীবন বাঁচাতে পোনা মাছ শিকার করছেন। কখনো পাচ্ছেন, কখনো খালি হাতে ঘরে ফিরছেন।
IMG_1
আশরাফ হাওলাদার, আমীর হোসেনসহ আরও কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কুকরী মুকরীর অন্যতম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মনুরা বাজারে। ভর দুপুরে প্রায় জনশুণ্য বাজারটি। কিছু জেলে নদী তীরে নিজেদের জাল মেরামতের কাজে ব্যস্ত। বাজারের দুটো হোটেলের কোনটিতেই দুপুরের খাবারের জন্য রান্না হয়নি। হোটেল মালিকেরা জানালেন, হোটেলে ভাত খাওয়ার ক্রেতা নেই।

তেঁতুলিয়া নদীর শাখা হয়ে মনুরা বাজারের গা ঘেঁসে চলে গেছে ছোট্ট নদী। জোয়ারে কানায় কানায় ভরে উঠলেও ভাটায় একেবারেই শুকিয়ে যায় নদীটি। মাছের মৌসুমে এখানে হাজার হাজার ট্রলার ভিড়লেও আকালের মৌসুমে চোখে পড়লো প্রায় ট্রলার শুন্য ঘাট। অথচ এই ঘাটে ভিড় জমে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের। দৈনিক লেনদেন হয় অন্তত কোটি টাকার।

এলাকার ওয়ার্ড মেম্বার আবদুস সালাম মুন্সী বলেন, মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাস ইলিশ মৌসুম। এসময় এই মনুরা বাজার সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে চলে খুটাজালে মাছ ধরা। পাওয়া যায় বিভিন্ন মাছ। এ মৌসুমেও জেলেদের হাতে মোটামুটি কাজ থাকে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাস জেলেসহ সব পেশার মানুষের জন্য কষ্টের।           

কুকরী মুকরী ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র পুরান বাজার থেকে খানিক দূরে ডাকাতিয়া মাছঘাটে ভর দুপুরে কোন লোকের দেখা মেলেনি। বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু খাল। এই খালের পাড়েই ডাকাতিয়া মাছঘাট। দোকানগুলো তালাবদ্ধ। শুকনো খালে কাত হয়ে পড়ে আছে ট্রলার-নৌকা। অথচ মাছের মৌসুমে এই ঘাট থাকে জমজমাট। সমুদ্র-নদী থেকে মাছ ধরে বহু ট্রলার ভেড়ে এখানে। দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় করেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
IMG_2
মাছের মৌসুম নেই বলে কর্মহীন মানুষের দেখা মেলে কুকরী মুকরীর বিভিন্ন স্থানে। বাবুগঞ্জ গ্রামের দোকানদার আবুল কালাম বাড়ির সামনের দোকানটি খোলেন ঠিকই, কিন্তু বেচাকেনা একেবারেই নেই। বাবুগঞ্জ গ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মনুরা পর্যন্ত এখানকার একমাত্র পাকা সড়কে টেম্পো চালান মো. ইব্রাহিম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও টেম্পোতে যাত্রী খুব একটা মেলে না। ইব্রাহিম তাই কাজের সন্ধানে রাজধানীতে যেতে চান।

দ্বীপের প্রাণকেন্দ্রে পুরান বাজারটি বসে প্রতিদিন সন্ধ্যায়। সকালে কিংবা দুপুরে বাজারটি দেখলে মনেই হয়না এটি পড়ন্ত বেলায় জমজমাট হয়ে ওঠে। সব দোকানপাট তখন বন্ধ থাকে। বিকেল চারটার দিকে লোকজন আসতে শুরু করেন এখানে। ভাসমান দোকানিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন খোলা আকাশের নিচে। স্থায়ী দোকানিরাও তাদের দোকান খোলেন। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এখানে হাট বার, তবে সে দিনটিকে অন্যান্য দিন থেকে আলাদা করার কোন উপায় নেই।

এই বাজারটি গোটা ইউনিয়নের মিলনমেলা হিসেবেই পরিচিত। সারাদিন সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যায় সবাই একত্রিত হন এখানে। শুধু হাটবাজার নয়, এখানে এসে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। কেউবা আসেন বাজারের চায়ের দোকানে বসে এককাপ গরম চায়ে চুমুক দিতে। একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করেন, কুশলাদি বিনিময় করেন পরিবারের।

বাজারের ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, কুকরী মুকরীতে এখন চলছে আকালের দিন। জেলেরা বেকার। বহু মানুষ ছুটেছে অন্য কাজে। মানুষের হাতে তেমন টাকা-পয়সাও নেই। সে কারণে বাজারও তেমন জমছে না। এ মৌসুমে এখানকার সবাই কষ্ট করে দিন কাটায়। অপেক্ষায় থাকে আবার কমে জমবে মাছের হাট।   
                 
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।