ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

বিপদের বন্ধু রেডিও ‘সাগরগিরি’

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৯ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৪
বিপদের বন্ধু রেডিও ‘সাগরগিরি’

সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম ঘুরে এসে: ‘ঝড়ের রাত। ধেয়ে আসছে দুর্যোগ।

বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার! কোনো খবর পাচ্ছি না! কী হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। মোবাইল ফোনের রেডিও শুনে জানতে পারি, ভয়ের কোনো কারণ নেই। ঝড় অন্যদিকে ছুটছে। ’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রেডিও শ্রোতা আবুল হোসেন এ ভাবেই বাংলানিউজকে জানাচ্ছিলেন, দুর্যোগকালে রেডিওর সহায়তার কথা। তিনি নিয়মিত রেডিও ‘সাগরগিরি’ শোনেন। এখান থেকেই পান দুর্যোগসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য। স্থানীয় পর্যায়ের নানান তথ্য পান রেডিওর কাছ থেকে।

দেশে প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পাওয়া ১৪টি কমিউনিটি রেডিওর মধ্যে একটি হচ্ছে- ‘সাগরগিরি’। তথ্য দিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার বিপন্ন মানুষদের সহায়তার লক্ষ্যে এই রেডিওর যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ২৪ মার্চ। ‘সবার কথা বলে’ স্লোগান সামনে রেখে এ রেডিওর সম্প্রচার স্টেশন থেকে ১৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।

ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ১২টা। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নে ছায়াঘেরা গ্রামীণ পরিবেশে রেডিও ‘সাগরগিরি’ স্টেশন টিউন করতেই উপস্থাপনের ঘোষণা। শুরু হয়ে গেল দিনের পাঁচ ঘণ্টার অনুষ্ঠানমালা।



‘বন্ধু আড্ডা গান’, ‘প্রিয় গান প্রিয় কলি’, ‘কুইজগিরি’ ‘আলোর পাখিরা’, ‘এসো জানি’সহ দিনজুড়ে চলে নানান অনুষ্ঠান।

চাষি-জেলেসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের রয়েছে পৃথক অনুষ্ঠান। রেডিওতে খবরও প্রচারিত হয়, এর মধ্যে কিছু আবার আঞ্চলিক ভাষায়ও প্রচারিত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানালেন, সমুদ্র উপকূলবর্তী এই এলাকায় কমিউনিটি রেডিওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জরুরি আবহাওয়া বার্তা প্রচারে। বিদ্যুৎ চলে গেলে এই এলাকার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা সমুদ্রের জেলেরা কোনো ধরনের তথ্য পান না।

এমনকি সমুদ্রের উপকূলে থাকা লোকজনও তথ্য শূন্যতায় থাকেন। এর ফলে জরুরি মুহূর্তে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

এ কারণেই তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কমিউনিটি পর্যায়ের এই কমিউনিটি রেডিও স্থানীয় মানুষদের জরুরি বার্তা দিয়ে, দিক-নির্দেশনা দিয়ে সচেতন করতে পারছে।

স্টেশনে জড়ো হওয়া রেডিও ‘সাগরগিরি’র শ্রোতারা বাংলানিউজকে জানালেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’র সময় এই রেডিও মানুষের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঘূর্ণিঝড় আসবে কিনা, এলাকার মানুষ বুঝতে পারছিলেন না। এই সময় রেডিও ‘সাগরগিরি’ পথ দেখায়। শুধু জরুরি আবহাওয়া বার্তাই নয়, সেই সঙ্গে দিক-নির্দেশনাও প্রচার করে। দুর্যোগে বিদ্যুৎ না থাকলেও জেনারেটর দিয়ে স্টেশনের কার্যক্রম চালু রাখা হয়।

রেডিও ‘সাগরগিরি’র প্রোগ্রাম প্রডিউসার মোহছেনা আক্তার মিনা বাংলানিউজকে বলেন, সামাজিক পরিবর্তনের কথা বিবেচনায় রেখে রেডিও’র প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, আদিবাসী, বনায়ন, নারী, শিশু, যুবক-তরুণ সমাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়। আর এর সঙ্গে সব শ্রেণীর মানুষদের সম্পৃক্ত করা হয়। এর ফলে কমিউনিটি পর্যায়ের এই রেডিও সামাজিক পরিবর্তনে সাহায্য করছে।

সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসার মুসলিম উদ্দিন পারভেজ বলেন, এই রেডিও তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক সারা ফেলেছে। রেডিওর লাইভ অনুষ্ঠানগুলোতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অসংখ্য এসএমএস ও ফোন পাওয়া যায়। আবার লাইভ অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পেরে অনেকে ধূমপান, যৌননিপীড়নের মতো খারাপ অভ্যাস থেকে সরে এসেছেন।

এদিকে, রেডিও সূত্র জানায়, মাত্র তিনজন বেতনভুক্ত কর্মী আর ৩০ জন ভলান্টিয়ার নিয়ে চলছে এই রেডিও স্টেশন ‘সাগরগিরি’। ভলান্টিয়াররা প্রশিক্ষণ পেয়ে প্রডিউসার, উপস্থাপকসহ বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে তাদের এ দায়িত্ব পালনও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। কারো কোনো বেতন নেই। অথচ কাজের পরিধি অনুযায়ী, এই ষ্টেশনে অন্তত ১০ জন বেতভুক্ত কর্মী প্রয়োজন।

রেডিও সূত্র বলছে, এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রেডিওর নিয়মিত শ্রোতা সংখ্যা ৫০ হাজারের ওপরে। অনিয়মিত শ্রোতা একলাখের বেশি। মোবাইল ফোন ও এফএম রেডিওতে শ্রোতারা অনুষ্ঠান শুনতে পারেন। দুপুর ১২টায় শুরু হয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয় বিকেল ৫টায়। এ রেডিওর অনুষ্ঠান শোনা যায় চারিদিকে ১৭ কিলোমিটারের মধ্যে। পূর্বে ফটিকছড়ি, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল, উত্তরে মিরসরাই এবং দক্ষিণে কুমিরা পর্যন্ত শ্রোতারা অনুষ্ঠান শুনতে পারেন।

রেডিও স্টেশনের প্রযোজক (কারিগরি) সঞ্জয় চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে অ্যাডভোকেসির কাজে এ রেডিও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে এলাকার তরুণ সমাজ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও একদল শ্রোতা তৈরি হচ্ছে, যারা রেডিওর খবরের ওপর নির্ভর করে নিজেদের জীবনমানের পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন।       

দাতাসংস্থার কোনো সাহায্য ছাড়াই নিজেদের অর্থায়নে রেডিও ‘সাগরগিরি’ পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা- ‘ঈপসা’। সীতাকুণ্ডের ঈপসার নিজস্ব ভবনে স্থাপন করা হয়েছে এ স্টেশন।

সাগরগিরি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঈপসার নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, তৃণমূলের মানুষদের যত বেশি তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে, তারা ততটাই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবেন। রেডিওর মাধ্যমে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিয়ে জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে রেডিও ‘সাগরগিরি’র যাত্রা শুরু হয়। এই অল্প সময়ের মধ্যে বহু মানুষকে ‘সাগরগিরি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে।    
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে বিশেষ বিভাগে।

আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫২ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।