ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

১১ জেলের ৮ ঘণ্টা শ্রমে মিললো ৭ ইলিশ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৪
১১ জেলের ৮ ঘণ্টা শ্রমে মিললো ৭ ইলিশ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মাছধরা ট্রলার, চর নিজাম, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে: উত্তাল সমুদ্র মোহনায় ১১ জেলের টানা ৮ ঘণ্টা পরিশ্রমে মিললো মাত্র ৮টি ইলিশ। এর মূল্য দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১৬শ’ টাকা।

আর সারাদিনের খাওয়া-দাওয়া ও জ্বালানি মিলে এই মাছ ধরতে মাঝারি সাইজের এই ট্রলারের খরচ হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা। এভাবেই এবার লোকসান গুনছেন জেলেরা। ধার-দেনা পরিশোধ তো দূরের কথা, নিজেদের তিনবেলা খাবারের অর্থ যোগাড়ই যেন তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরা সদর থেকে দক্ষিণে সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা চর নিজাম বর্ষায় জেলেদের পদচারণায় ভারি হয়ে উঠলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। প্রতি বছর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু ট্রলার এখানে জড়ো হয়ে ইলিশ ধরার আশা নিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে। এবার ইলিশের পরিমাণ অনেক কম থাকায় জেলের সংখ্যা অনেক কম। বর্ষায় চর নিজামের কালকিনি বাজার রাতদিন জমজমাট থাকলেও এবার একেবারেই ঘুমিয়ে।

কিন্তু তারপরও ইলিশ পাওয়ার আশা নিয়ে সেখানে ছুটে অনেকে। এদের মধ্যে একজন সিরাজ উদ্দিন। এক ট্রলারের জেলেদের প্রধান। সিরাজ মাঝি নামে পরিচিত। জেলেরা দক্ষতা অর্জন করে ‘মাঝি’ পদে আসেন। তার নির্দেশেই চলে ট্রলার। কোথায় জাল ফেলা হবে, ট্রলার কোন দিকে চলবে, কখন বাড়ি ফেরা হবে, সবকিছুই নির্ভর করে মাঝির ওপর। সিরাজ মাঝির ট্রলারে ১৩ জন জেলে। সবার বাড়ি ভোলার চরফ্যাসনের বিভিন্ন এলাকায়।

এই বর্ষায় সমুদ্র কিংবা সমুদ্র মোহনায় একবার জাল ফেলতে কতটা পরিশ্রম করতে হচ্ছে জেলেদের, আর কী মিলছে এই শ্রমের বিনিময়ে, তারই খোঁজে ৮ আগস্ট সারাদিন সরেজমিনে সিরাজ উদ্দিন মাঝির ট্রলারে ঘুরেছে বাংলানিউজ। কীভাবে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে জেলেরা একটা সময় অবস্থান করে, কীভাবে তাদের সময় কাটে, অবশেষে ট্রলারের ইলিশের বক্সে কী জমা হয়, সেসব তথ্য মিলেছে।
 
ভোর ৫টা: সমুদ্র যাত্রা
পুবের আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। কিছু মাধধরা ট্রলার-নৌকার ব্যস্ততা। চর নিজামের কালকিনি মাছ বাজারের আড়তের দরজা খুলেছে। এরইমধ্যে কালকিনি মাছ ঘাট থেকে ছেড়ে দিল সিরাজ মাঝির ট্রলার। একপাশে চর নিজাম আর অন্যপাশে আলম চর রেখে ট্রলার ছুটছে সোজা দক্ষিণে। ট্রলারের ভেতরে সকালের খাবারের আয়োজন চলছে। ট্রলারের ভেতরে কয়েকজন জেলে আরও খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিচ্ছে।   এদিকে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাতাসের গতি বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের ঢেউ।

ভোর ৬টা: চারিদিকে ধু ধু জলরাশি
ট্রলার মেঘনার মোহনা পেরিয়ে সমুদ্র মোহনার দিকে ছুটছে। চারিদিকে ধু ধু জলরাশি। দু’একটি চরের দিগন্ত রেখা দেখা যায় মাত্র। সেগুলোও ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেলেও আকাশ ভারি হয়ে আছে। সমুদ্রের ঢেউ বড় হয়ে ট্রলার দুলিয়ে চলছে। এরই ভেতরে ট্রলারের যাত্রা সমুদ্রের দিকে। ট্রলারের কয়েকজন জেলে এখনও ঘুমাচ্ছেন। এরইমধ্যে বাংলানিউজের সঙ্গে জেলেদের পরিচয়।

ট্রলারে ১৩ সদস্যের জেলেদল। দু’জন ছুটিতে। অন্যরা হলেন- সিরাজ উদ্দিন (মাঝি), আবদুল কাদের (ডাইনা মাঝি), আলতাফ হোসেন (মিস্ত্রি), ইউনুস চৌধুরী (ভাগী), মো. জিয়াদ (ভাগী), মো. হাসান হাওলাদার (ভাগী), আবু বকর ঢ়াড়ি (ভাগী), মিজানুর রহমান ঢ়াড়ি (ভাগী), মিজানুর রহমান শাহ (ভাগী), আমীর হোসেন ঢালী (ভাগী) এবং মো. হাছান (বাবুর্চি)।

ভোর ৬-২৪: জাল ফেলা শুরু
সমুদ্র মোহনায় ট্রলার কিনারের দিকে ঘুরতেই সব জেলেরা প্রস্তুত। শুরু হলো জাল ফেলা। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে ট্রলার দুলতে থাকলেও জেলেদের কাছে এটা স্বাভাবিক। যে যার অবস্থানে চলে যান। এজন্য দলনেতার (মাঝি) কোন নির্দেশনা প্রয়োজন পড়লো না। ট্রলারের ছাদে মাঝি (চালক), নিচে ইঞ্জিনে মেশিন চালক (মিস্ত্রি) আর রান্নায় বাবুর্চি বাদে সবাই সামনে। ট্রলারের সামনে সাজানো ইলিশ জাল যেন ছন্দে ছন্দেই নদীতে পড়ছে। তিনজন জালের উপরের অংশের ভাসা(ফ্লুট) ফেলানোর কাজে, তিনজন জালের নিচের অংশ চাকি ফেলানোর কাজে, বাকি দু’জন অন্যান্য কাজে।

ভোর ৬-৪২: জাল ফেলা শেষ
প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথে ইলিশের জাল ফেলা হল। জাল ফেলা শেষ মানে জেলেদের ইলিশ পাওয়ার প্রতীক্ষা আরও বেড়ে যায়। অধীর আগ্রহ নিয়ে কেউ বসে আছেন, কেউবা আরও একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। এরইমধ্যে ট্রলারের ইঞ্জিন থেমে গেল। জেলেদের কেউ কেউ ট্রলারের সামনের অংশ ধুয়ে পরিস্কার করল। কারণ এখানে আবার জাল রাখা হবে।

সকাল ৭টা: ইলিশের অপেক্ষায়
থেমে থাকা ট্রলারটা নদীতে ফেলা জালের সঙ্গে ভাসছে। ইলিশের অপেক্ষায় বসে আছেন জেলেরা।   জোয়ারের সঙ্গে এই ভাসমান ট্রলারটা যেন কিনারের দিকেই খানিক এগুচ্ছে। ইলিশের জাল ফেলা হয়েছে এই জোয়ার সামনে রেখেই। জোয়ারের সঙ্গে সমুদ্র থেকে ইলিশ উঠে আসবে। আর আটকা পড়বে এই জালে। সাধারণত জোয়ার সামনে রেখেই ইলিশ জাল ফেলা হয়। জোয়ারের শুরুতে জাল ফেলা হয় আর ভাটা আসতে না আসতেই জাল তোলা হয়।

সকাল ৮টা: জেলেরা বিশ্রামে
ইলিশ জালের দুই প্রান্তে দু’টি পতাকা। মাঝখানে ভাসছে সাদা রঙের ছোট ছোট ভাসা (জেলেদের ভাষায় ফ্লুট)। ট্রলারের দায়িত্বে মাত্র দু’জন। ডাইনা মাছি(সহকারী মাঝি) আবদুল কাদের চোখ রাখছেন জালের অপরপ্রান্তে রাখা পতাকার দিকে। ওটা দেখেই বোঝা যাবে জাল ঠিক আছে কীনা। অন্যদিকে বাবুর্চি মো. হাসান খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত। অন্য জেলেরা বিশ্রামে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ কখনো বাড়ছে কখনো কমছে।

সকাল ৯টা: ট্রলার কেবিনে সকালের খাবার
সবাই বসে গেলেন সকালের খাবারে। আগের রাতের পান্তা ভাত আর গুড়ো মাছ। ট্রলারের ছোট্ট কেবিনে সবাই একসঙ্গে বসেছেন। বাবুর্চি টিনের প্লেটে ভর্তি করে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। পাটাতনের নিচে ট্রলারের ইঞ্জিন, তারই উপরে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারলেন। সমুদ্রের উত্তালে ঠিকভাবে বসে খাওয়াটাই যেন কঠিন। তবুও এরা পারদর্শী। এখানেই তারা সব বেলা খাওয়া-দাওয়া করেন, ঘুমান এবং অবসর কাটান।

সকাল ১০-৩৯: জাল টানা শুরু
ট্রলারের মাঝির যেন মুখে কিছুই বলার প্রয়োজন হয় না। থামানো ট্রলারটি স্টার্ট করে জালের বিপরীত প্রান্তে গিয়ে থামতে না থামতেই জেলেরা জাল তোলার জন্য প্রস্তুত। যে যার অবস্থানে চলে গেলেন। শুরু হলো জাল তোলা। একদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, অন্যদিকে সমুদ্রের ঢেউ উপেক্ষা করে কঠোর পরিশ্রমে জেলেরা জাল তুলছেন। শুধু মাঝি (চালক) আর মেশিনম্যান (মিস্ত্রি) নিজের দায়িত্বে পেছনে রয়েছেন। বাবুর্চিকেও জাল তোলার সময় সামনে আসতে হলো।

দুপুর ১২-৩৮: ইলিশ মিললো ৭টি
জাল টানা শেষ। জেলেদের কঠোর পরিশ্রমে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার জাল তুলে ইলিশ মিললো মাত্র ৭টি। গভীর জলে ভেসে থাকা জালের শেষ ফ্লাগটি তোলার আগ পর্যন্ত জেলেদের বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। ৮ ঘণ্টায় পাওয়া ৭ ইলিশের মধ্যে ছোট দুটি রান্না হলো দুপুরের খাবারের জন্য। বাকি ৫টি ইলিশ ট্রলারে বরফজাত হল।

দুপুর ১টা: ঘাটে ফিরলো ট্রলার
ভোর ৫টা থেকে টানা ৮ ঘণ্টা পরিশ্রমের পর ট্রলার ঘাটে ফিরলো। জেলেরা কেউ বসেছেন জাল মেরামতের কাজে, কেউবা গোসলে ব্যস্ত, বাবুর্চি দুপুরের রান্না শেষ করছেন। আবার রাত হবে, আবার ভোরের প্রস্তুতি শুরু হবে। জেলেরা ট্রলার নিয়ে ছুটবেন সমুদ্রে।

ঘাটে ফিরে আলাপ ট্রলারের মাঝি সিরাজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, একবার সমুদ্রে যেতে সব মিলে প্রায় চার হাজার টাকা খরচ হলেও তেমনটা ইলিশ মিলছে না। জেলেরা ধারদেনা শোধ করতে পারছে না। প্রতিটি ট্রলার লাখ লাখ টাকা দাদন নিয়ে ইলিশ ধরতে নেমেছে। কিন্তু সেই দাদন কীভাবে শোধ হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০২৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।