ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

যুদ্ধটা যখন লেখাপড়ায় টিকে থাকার!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৪
যুদ্ধটা যখন লেখাপড়ায় টিকে থাকার! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালুয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: দুই কিলোমিটার দূরের স্কুল থেকে বিকেলে বাড়ি ফেরা। গোসল আর দুপুরের খাবার বাড়িতেই।

রাত ও পরের দিন ভোরের খাবার নিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে স্কুলের কাছে প্রাইভেট টিচারের বাসায় যাওয়া। সেখানেই স্যারের কাছে রাতে লেখাপড়া এবং ঘুমানো। সকালে সেখান থেকেই স্কুলের পথে। স্কুলের ক্লাস শেষে পড়ন্ত বেলায় বাড়ি ফেরা।

এটা এক নজরে একজন শিক্ষার্থীর দিনপঞ্জি। সারাদিনে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে রীতিমত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। বাড়ি কিংবা রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে এই ভয়ে খাবার-দাবার নিয়ে স্কুলের কাছেই থাকে ওরা। একইসঙ্গে স্যারের কাছেও পড়া হলো, অন্যদিকে স্কুলের কাছাকাছিও থাকা হলো।

শহুরে শিক্ষার্থীদের কাছে এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হলেও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়াসহ আশপাশের গ্রামগুলোর ছেলেমেয়েদের কাছে এটা একেবারেই গা-সওয়া। শুধু চারিপাড়া নয়, আশপাশের অন্তত দশ গ্রামের শিক্ষার্থীরা এভাবেই প্রতিনিয়ত লেখাপড়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। লালুয়া ইউনিয়নের বানাতী বাজার থেকে বিলের ভেতর দিয়ে চারিপাড়া যাওয়ার সময় কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা। সবার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দেখেই প্রশ্ন জাগে। একে একে আলাপ। জহিরুল, পিতা-আনসার মীর, সপ্তম শ্রেণী; রাজিব, পিতা-শান্তি চৌকিদার, সপ্তম শ্রেণী; ইমরান, পিতা-সানু দফাদার, সপ্তম শ্রেণী; হাসান, পিতা-জালাল হাওলাদার, সপ্তম শ্রেণী। কথা বলতে বলতে ভিড় করলো আরও কয়েকজন।

বিকেল হলেই টিফিন ক্যারিয়ার হাতে এই শিক্ষার্থীরা ছোটে স্যারের কাছে। একদিকে স্যারের কাছে পড়াটাও যেমন জরুরি, তেমনি জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের দুর্যোগ থেকে বাঁচতে নিরাপদে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়াটাও জরুরি। সে কারণে চারিপাড়া, এগারো নম্বর হাওলা, ধঞ্জু পাড়া, চৌধুরী পাড়া, নয়াকাটাসহ আশপাশের এলাকার কয়েকশ’ শিক্ষার্থী লালুয়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র বানাতী বাজারে গিয়ে লেখাপড়া করে। ওই বাজারে বেশ কয়েকজন শিক্ষক বাসা ভাড়া নিয়ে ২০-৩০জন করে ছেলেমেয়েদের সব বিষয়ে লেখাপড়া করান।

বাসায় পড়াশুনা করতে সমস্যার কথা জানিয়ে জহিরুল বললো, ‘বাসায় লেখাপড়ার পরিবেশ নেই। জোয়ারের পানি উঠে ঘরের অনেক সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে পড়ার টেবিলটা রাখার মতো কোন স্থান নেই। জোয়ারের পানি বাড়লে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বইপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তাই স্কুলের কাছে গিয়ে স্যারের বাসায় পড়ি। ’

রাজিব তার পরিবারের সঙ্গে রামনাবাদ নদীর তীরে নয়াকাটা গ্রামের বেড়িবাঁধের ওপর থাকে। রাজিব জানালো, ‘বাড়িঘর নদীতে ভেঙ্গে যাওয়ার পর বাঁধের ওপরে ছোট্ট ঝুঁপড়িতে ঠাঁই হয়েছে। সেখানে লেখাপড়ার পরিবেশ তো দূরের কথা, ঠিকভাবে পাঁচজনের থাকার জায়গাই হচ্ছে না। স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে খাবার নিয়ে আবার স্কুলের কাছের বাজারে স্যারের বাসায় গিয়ে পড়াশুনা করি। ’

অভিভাবক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘পানির কারণে বাড়িঘর এলোমেলো। ঘরে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। পড়ার জন্য আলো, টেবিলের সংকট আছে। তাছাড়া জোয়ারের পানি বাড়লে বাড়ি থেকে স্কুলে যেতেও সমস্যা হয়। স্যারের কাছে গিয়ে পড়লে পড়াটাও ভালোভাবে দেখিয়ে দিতে পারেন। ’

চারিপাড়া গ্রামের শেষপ্রান্তে চারিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শেষ বিকালেও ছেলেমেয়েদের ভিড় লক্ষ্য করা গেল। মনে হয় স্কুল কেবল ছুটি হয়েছে। আসলে তা নয়। ছেলেমেয়েরা স্কুলে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে এসেছিল। কিছু ছেলেমেয়ে রাতেও স্যারের কাছে পড়ে। কিছু আবার বিকালে পড়ে বাড়িতে চলে যায়। একই কথা জানালেন তারাও, বাড়িতে লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় তারা রাতে কিংবা বিকেলে স্যারের কাছে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখছে।

লালুয়া ইউনিয়নের কেন্দ্রবিন্দু বানাতী বাজারে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার লড়াইয়ে সহযোগিতা করছেন। এদের মধ্যে একজন সিদ্দিকুর রহমান। স্থানীয় কেরাতুল কোরআর মাদ্রাসার শিক্ষক তিনি। ছেলেদের রাতে লেখাপড়া করানোর জন্য তিনি বানাতী বাজারে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, দোতলার পাটাতনের ওপরে, চৌকিতে, এমনকি মেঝেতে বসে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। মাথার ওপরে জ্বলছে সৌর বিদ্যুতের আবছা আলো।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, স্কুলের সময় ছাড়া দিনের বাকি সময়টা ছেলেরা এখানেই পড়াশুনা করে। দুর্গম এলাকা চারিপাড়া থেকেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসে। বর্ষাকালে ওই এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। ফলে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। এখানে থেকে পড়াশুনা করার ফলে ওরা সময়মত স্কুলে যেতে পারছে। স্কুলের পড়াটাও ঠিকমত তৈরির সুযোগ পাচ্ছে।       

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, বিপন্নতার কারণে এই এলাকার ছেলেমেয়েরা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। যারা এইসব ঝামেলা মোকাবেলা করে লেখাপড়ায় টিকতে না পারছে তারা ঝরে পড়ছে। লেখাপড়ার পরিবেশ ফেরানোর দাবি তোলেন এলাকার মানুষ।       
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।