ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ভোরের সূর্যের সাক্ষাৎ সোনাদিয়ায়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
ভোরের সূর্যের সাক্ষাৎ সোনাদিয়ায়! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোনাদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার থেকে: পুব আকাশে রক্তিম আভা। গাছে গাছে পাখিদের ডাকাডাকি।

সৈকতের কিনারে ঠায় দাঁড়িয়ে গগনমূখী ঝাউবন। সমুদ্র তীরে ভোরের নীরব-নিস্তব্ধতা। নোনাজলে ভাটার টানে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রটা যেন একেবারেই শান্তশিষ্ট।

ট্রলার ভিড়ছে, মাছ আর জাল নিয়ে ঘরে ফেরার তাড়া জেলের। এরই মাঝে সমুদ্রের জলে স্বর্ণালী ঝিলিক ছড়িয়ে এক নতুন সূর্যের আগমন। সোনাদিয়ার সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ফিরে পায় প্রাণ। কর্মজীবী মানুষের দলভারি হয় সৈকত জুড়ে।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার শেষপ্রান্ত দ্বীপ সোনাদিয়ায় সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা এমনই। এ দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমী সব মানুষকেই টানে সমুদ্র সৈকতের দিগন্তে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম দ্বীপে নির্জনে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার সুযোগ এখানে রয়েছে এখনও। শুধু সূর্যোদয় নয়, একই বেলাভূমিতে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের দৃশ্যটাও অপরূপ-নয়নাভিরাম। তবে পশ্চাদপদতায় ইচ্ছা থাকলেও সবার পক্ষে সোনাদিয়ার সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

মহেশখালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সোনাদিয়ার বেলাভূমি। এর প্রায় অর্ধেকটাই হাঁটা কিংবা ট্রলারের পথ। হাঁটা পথে শুকনো সময়েও কাদা-পানির ওপর দিয়ে রাস্তা পেরোতে হয়। এ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও প্রকৃতিপ্রেমীরা ছোটেন এই দ্বীপে। সকাল-দুপুর-বিকালে কিছু মানুষ সেখানে যান পায়ে হেঁটেই।

বিপুল সম্ভাবনা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সোনাদিয়ার সার্বিক চিত্র তুলে আনতে সেখানে অবস্থান করে বাংলানিউজ পেয়েছে নানা তথ্য। আর এরই এক ফাঁকে নয়নাভিরাম এ দ্বীপের বেলাভূমিতে উদীয়মান সূর্যের সাক্ষাত মিলেছে।

কুয়াশাহীন পৌষের ভোরের আকাশটা ছিল একেবারেই পরিস্কার। ভোররাতে দ্বীপের মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। বাইরে তখনও আবছা আলো। ভাটার টানে সমুদ্রের গর্জনের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। তখনও হালকা কুয়াশায় ঢাকা ঝাউবন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুবের আকাশ আরও পরিস্কার হচ্ছে। শিশির ভেজা শুকনো বালু কোথাও কোথাও জমাট বেঁধে আছে।

এসব দৃশ্য অবলোকন করতে করতেই চোখে ভাসে সূর্যহীন এক পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ। সমুদ্র তীরে অপেক্ষা সূর্য ওঠার দৃশ্য দেখার জন্য।

সমুদ্রের জলরাশির ভেতরে সূর্যের ওপরের অংশের হালকা রক্তিম বৃত্তটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। লাল বর্ণ সূর্যটা অল্পক্ষণের মধ্যেই পূর্ণ বৃত্তে রূপ নেয়। রশ্মিহীন এই নতুন সূর্যটা পুব আকাশের নিয়ে আসে এক অপরূপ শোভা।

আকাশের ক্যানভাসে আঁকা বৃহৎ আকৃতির সূর্য, নিচে সমুদ্রের নীল জল, সুদীর্ঘ বেলাভূমি আর এরই পাশে ঘন সবুজ ঝাউবনের সমন্বয়ে সোনাদিয়া ফিরে পায় অপরূপ সৌন্দর্য। এ দৃশ্য যে কেউ খুব সহজেই কল্পনা করতে পারলেও বাস্তবে দেখাটা খুবই কঠিন। দ্বীপ সোনাদিয়ায় এরই বাস্তব রূপায়ন।

ক্রমেই সূর্য ওপরের দিকে উঠতে থাকে। তার পথ তো দীর্ঘ। যেতে হবে পুবের আকাশ পেরিয়ে পশ্চিম আকাশে। সময় তো বেশি নেই। খানিকক্ষণের মধ্যেই ভোরের নতুন সূর্যটা রশ্মি ছড়িয়ে সমুদ্রের নীল জল আর বালুকাবেলায় যেন সোনা ছড়িয়ে যায়। মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায় দৃশ্যপট। ক্যানভাসে নতুন রঙ, নতুন আলো। একই সঙ্গে আকাশ আর সমুদ্রের জলেও যেন ভিন্ন ভিন্ন রূপ।

সূর্যের রশ্মিতে চর চকে সমুদ্রের জলে দু’একটি মাছধরার নৌকা এ দৃশ্যকে যেন আরও মোহনীয় করে তোলে।

পুব আকাশে আলো ফোটার সঙ্গে এখানকার মানুষের জীবিকার নিবিড় সম্পর্ক। সূর্য ওঠার আগেই দ্বীপবাসীর কর্মদিবসের সূচনা। কেউ সমুদ্র থেকে আসা মাছধরা ট্রলারের অপেক্ষায়। কেউবা ট্রলারে করে দূরে কোথাও যাওয়ার অপেক্ষায়। বাদ নেই নারী আর শিশুরাও। লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে শীতের ভোরে কিছু সময় কাটানো সুযোগ এদের নেই। সারাদিনে পড়ে থাকা হাজারো কাজের শুরুটা করতে হয় অতি ভোরেই। কোনো কোনো শিশুকে আবার দেখা গেল মাছধরার নৌকা থেকে নামতে। ওরা রাতে নৌকায় থাকে। বড়দের সঙ্গে মাছ ধরে।

ছোট্ট নৌকাটা ঘাটে বেঁধে কিনারে উঠে আসা একজন সুমন। বয়স আট বছরের বেশি হবে না। শীতের কিছু মোটা কাপড় গায়ে জড়ানো আছে ঠিকই, তারপরও শীতে কাবু হয়ে হয়ে শিশুটি। জানালো, আরও ছোট বয়স থেকে ওর কাজের শুরু। বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া, ঝিনুক কুড়ানো, চিংড়ির পোনা ধরে তার দিন কাটে।

বেলাভূমিতে দু’চারজন শ্রমজীবীর সঙ্গে আলাপ করতে করতেই সূর্যের তেজটা যেন অনেকটাই বেড়ে গেল। সৈকত পেল আরেক রূপ। সূর্য বাড়ার সঙ্গে সৈকতে মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ঝিনুক কুড়ানি শিশুদল ছুটে আসতে থাকে সৈকতে। ভাটার সময় সমুদ্রের হালকা ঢেউয়ে নানা রঙের ঝিনুক পাওয়া যায় এখানে।

ভোরে ভাটার টান থাকে বলে দ্বীপের বহু শিশু ঝিনুক কুড়াতে আসে। একই শিশুদলকে আবার বিকালেও দেখা যায়। একইসঙ্গে সৈকত জুড়ে থাকে বিভিন্ন বয়সী শ্রমজীবীদের কাজ।

ক্রমেই তেজ বাড়িয়ে দেয় সূর্য। শীত-ভোরের সৈকত পুরোপুরি জেগে ওঠে। বাড়তে থাকে উষ্ণতা। কোলাহলে মুখরিত হয় দ্বীপ সোনদিয়ায়। অবিরাম সমুদ্রের ঢেউ আঁছড়ে পড়ে সৈকতে। সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস ফিরিয়ে দেয় এক ভিন্ন ছন্দ।

দিন গড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্যটা সোনাদিয়া দ্বীপে আরেক সৌন্দর্য নিয়ে আসে। গোধূলিতে পাখির কিচির-মিচির শব্দ সূর্যাস্তের দৃশ্যটা আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। সূর্য ডোবে। রাত হয়। দ্বীপে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। আরেকটি নতুন সূর্যের অপেক্ষায় থাকে সোনাদিয়া।       

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।