ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

দখল-দূষণে বাঁকখালীর মৃত্যুঘণ্টা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৫
দখল-দূষণে বাঁকখালীর মৃত্যুঘণ্টা! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাঁকখালীর তীর, (কক্সবাজার) ঘুরে এসে : নদীর বুকে বসছে পিলার। ঠিক করা হচ্ছে বাড়ির নিশানা।

কোথাও উঠছে পাকা ভবন। আবার কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানি প্রবাহের শেষ ধারাটুকুও আটকে দেওয়া হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এককালে এখানে ছিল খরস্রোতা নদী। এই নদী ঘিরে এক সময়ের জমজমাট কস্তুরীঘাট এখন ঝিমোচ্ছে।

পাহাড় বেয়ে নেমে আসা বাঁকখালী নদী পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরের গাঁ ঘেঁষে সমুদ্রে মিলেছে। এই নদীকে ঘিরে আবর্তিত হতো এই এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য। বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র বদর মোকামের কস্তুরী ঘাট ছিল জমজমাট। ট্রলার ভিড়তো, মালামাল ওঠানামা করতো, বহু শ্রমিক সেখানে কাজ করতেন। ব্যবসা বাণিজ্য করেও দিন চলতো বহু মানুষের। সেই সময়ের কথা এই নদীতীরের মানুষেরা এখন কল্পনাও করতে পারেন না।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাঁকখালী মরে গেলেও তার কিছু চিহ্ন এখানে রয়ে গেছে। বন্দরের কাজে নিয়োজিত বিআইডাব্লিউটিএ ভবন দাঁড়িয়ে আছে নদীতীরে। সেখানে কোনো লোকজনের দেখা মিলল না। শুকিয়ে যাওয়া নদীর কিনারে রাস্তার পাশে পড়ে আছে পুরনো ট্রলার, স্পিডবোটসহ নানান যানবাহন। এগুলোই খরস্রোতা বাঁকখালীর প্রমাণ বহন করছে।

বাঁকখালী নিজে যে শুধু চিহ্ন রেখে গেছে তা নয়। বাঁকখালীর খরস্রোতা রূপ দেখেছেন এমন বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা মিলল নদীতীরে। কালের সাক্ষী হয়ে আছেন তারা। জানালেন, বাঁকখালীর সেকালের কথা। তাদের জীবন-জীবিকা, ব্যবসা বাণিজ্য সবই নির্ভর করতো বাঁকখালী ঘিরে।

একজন মোজাম্মেল হক। বয়স ৬৫ বছর। পেকুয়ার উজানটিলায় তার বাড়ি। বাঁকখালী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, নদী ছিল বলে বদর মোকামে জমজমাট ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। এই নদী দিয়ে বড় জাহাজ চলেছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বহু ট্রলার ভিড়েছে এই ঘাটে। এখন সে দিন নেই। ব্যবসা বাণিজ্যে ভাটা। দিন কাটছে কষ্টে।

আরেকজন আবদুল মালেক। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি কুতুবদিয়ায়। বললেন, এই ঘাট থেকে ট্রলারে করে সরাসরি কুতুবদিয়া চলে যেতেন। এখন নদীর তীর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে শহরের ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে ট্রলারে উঠতে হয়। নদীর তীর দখল করে বাড়িঘর উঠেছে। ঝাউবন কেটে বাড়ি করা হয়েছে।
    
বাঁকখালীর তীর ঘুরে দখলের নানান রূপ চোখে পড়ে। নদীর বুকে এমনভাবে বাড়িঘর উঠেছে, বোঝার কোনো উপায় নেই, এখানে এককালে নদী ছিল। কোথাও পিলার বসিয়ে নিজের এলাকার নিশানা ঠিক করা হচ্ছে। কোথাও বা নদীর তীরের বনের ভেতরেই বাড়ি উঠেছে। নদীর শেষ চিহ্নটুকুও ভরাট করে ফেলছে কক্সবাজার পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা। কেউ আবার ঘের তৈরি করেছে। এখানে যে এক সময় খরস্রোতা নদী ছিল, তা বোঝার কোনো উপায় নেই।

বদর মোকামের কস্তুরা ঘাট থেকে বাঁকখালী তীরের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর তীর লাগোয়া জমির দখলে থাকা ব্যক্তিরাই তাদের নিজ নিজ জমির সীমানা বাঁকখালীর অনেক ভেতরে নিয়ে গেছে। দ্রুত ভরাট করে নেওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থাও করে নিয়েছেন তারা। কেউ বাঁধ দিয়েছেন, কেউ মাটি ভরাট করেছেন। কোথাও আবার নদীর বুকেই নির্মিত হয়েছে রাস্তা। যেখানে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ছিল, সেখানে এখন পথচারীদের হাঁটা কিংবা যানবাহন চলাচলের রাস্তা।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, এককালের জমজমাট কস্তুরী ঘাট মরে গিয়ে জেগে উঠেছে ফিশারি ঘাট। এটি এখন জেলার একমাত্র মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বলে পরিচিত। এই ঘাটের আশপাশের এলাকাও এখন দখলের কবলে। ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে ২০টিরও বেশি বরফকল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি খাস জমিতে এসব বরফকল গড়ে উঠেছে। আর এই দখলের রয়েছে ভিন্ন কৌশল। বরফ কলের জেটিঘাটের পাশ দিয়ে প্রথমে ভাঙাচোরা ইট ফেলা হয়। এরফলে নদী পানি সরে গেলে বাউন্ডারি দিয়ে দখলে নেওয়া হয়। এখানে বাঁকখালীর তীর দখল করে ১০টির বেশি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

বদর মোকামের কস্তুরী ঘাটে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বহু মানুষের দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে। এক সময়ে এখানে ঘাট ছিল। এখান থেকেই যাত্রীরা ট্রলারে উঠত বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন এই ঘাট থেকে ছোট একটি রাস্তা নির্মিত হয়েছে। রাস্তার মাথা থেকে ঘাট পর্যন্ত চলে গেছে দীর্ঘ কাঠের জেটি। মালামাল বহনকারী হোক, কিংবা অসুস্থ যাত্রী হোক, সবাইকেই এই জেটি দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হয়। রাতের অন্ধকারে, বর্ষাকালে কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগে এ পথ হয়ে ওঠে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

এই ঘাটে আলাপ জেলা স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি মাওলানা রফিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিগত ২০-২৫ বছরে বাঁকখালীর মৃত্যু ঠেকাতে ড্রেজিং হতে দেখিনি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অব্যাহত দখল। একদিকে দূষণ, অন্যদিকে দখল, এভাবেই বাঁকখালী মরছে। নদী ভরাট হওয়ায় ঘাট অন্তত আড়াই কিলোমিটার দূরে সরে এসেছে। যেখানে বড় জাহাজ চলতো সেখানে এখন মানুষের হাঁটার পথ।

সূত্র বলছে, পাহাড়ি নদী বাঁকখালী কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়ন থেকে শুরু করে রামুর উপর দিয়ে বাংলাবাজার ব্রিজ হয়ে বদর মোকামের মোহনা পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। ড্রেজিং করে এই স্থানটুকু সচল করে দিলে বাঁকখালী আবার প্রাণ ফিরে পাবে। তবে ড্রেজিংয়ের আড়ে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।          

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।