শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ (কক্সবাজার): ‘পানি অইলে ঘরত থাহিত ন পারি। জোয়ার আইলে অন্য ঘরত যাইগই।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা ফরিদা বেগম নিজের আঞ্চলিক ভাষায় এভাবে বলছিলেন তার জীবনের কষ্টের কথাগুলো। যেন জোয়ার-ভাটার সঙ্গেই তার আবর্তিত তার বসবাস। বাঁধ ভেঙে জীবিকার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। জমিতে লবণ আবাদের শেষ সুযোগটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। এককালের দক্ষ লবণ চাষি তার স্বামী হারেস এখন মাছ ধরে পরিবারের ১০ সদস্যের খাবার যোগাড়ের চেষ্টা করেন।
শুধু ফরিদা একা নন, এমন অবস্থা এই দ্বীপের হাজারো মানুষের। কক্সবাজার জেলার উপকূল আর সীমান্ত লাগোয়া উপজেলা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ লবণ চাষ আর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দু’বছর ধরে লবণ আবাদের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বাঁধ ভেঙে লবণের মাঠ পানিতে ডুবে গেছে। লবণ চাষিদের অনেকে মাছধরা পেশায় ফিরেছেন, অনেকে আবার শহরে ছুটেছেন কাজের সন্ধানে।
শাহপরীর দ্বীপ ঘুরে সরেজমিনে পাওয়া তথ্য সূত্র বলছে, এক সময়ে টেকনাফের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনপদ এখন বিচ্ছিন্ন। দু’বছর আগে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি আর জলোচ্ছাসের ফলে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম দিকের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। অল্প কিছু ভাঙা অংশ ক্রমেই বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে এই ভাঙণ এখন এক কিলোমিটারের ওপরে। দ্বীপের লবণ মাঠ থেকে শুরু করে বাড়িঘর সবই তালিয়ে যাচ্ছে জোয়ারের পানিতে।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের আওতাধীন শাহপরীর দ্বীপ। এখানে রয়েছে ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড। লোকসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে এখানকার মানুষেরা প্রতিনিয়ত নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। অনেকেই কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে দ্বীপের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পাড়ার একটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। ওই গ্রামে প্রায় ২ হাজার লোক ছিল। এরা বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। বর্ষায় এই গ্রামের বাড়িঘর পানিতে ডুবে যায়। এই পানি থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসী নিজেদের উদ্যোগে ইট বিছানো রাস্তার পাশে মাটি দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। সে মাটিও গত বর্ষায় সরে গেছে। সামনের বর্ষা মৌসুমের আগে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করা হলে এ এলাকা থেকে আরও অনেক মানুষকে অন্যত্র সরে যেতে হবে।
দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পিচ ঢালাই সড়ক ছিল। ওই সড়ক দিয়ে সহজেই দ্বীপে যাতায়াত করা যেত। ওই সড়কে চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি যাতায়াত করা যেত। কিন্তু ওই সড়কটি পানির তোড়ে ভেসে যাওয়ায় এলাকার মানুষকে উপজেলা সদরে যাতায়াতে মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
দ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর পাড়া ঘুরে দেখা গেল, লবণের ভর মৌসুমে মাঠে পানির প্রবাহ বাইছে। চাষিরা লবণ মাঠে নামতে পারছে না। বেশকিছু জনশুন্য বাড়ি চোখে পড়ে রাস্তার পাশে। টিনের ছাউনি ঘর, পুকুর, উঠোন, গাছপালা, সবই পড়ে আছে, শুধু মানুষগুলো নেই। বাড়ি ও রাস্তার আশপাশের গাছপালা মরে যাচ্ছে। গ্রামে হাঁটার পথও থাকছে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, এই এলাকাটি টেকনাফের মূল ভূ-খণ্ডের একটি অংশ। কিন্তু বছরে বছরে জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে দ্বীপের বাঁধ ভেঙে গেছে। দু’বছরের বেশি সময় ধরে এখানকার মানুষেরা চরম সংকটের ভেতর দিয়ে দিন পার করছে। দ্বীপটি ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। দ্বীপের মানুষকে রক্ষায় অবিলম্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
শাহপরীর দ্বীপের সংকট নিয়ে আলাপ হল সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্বীপটি টেকনাফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এরফলে যোগাযোগ থেকে শুরু সব ধরনের সমস্যায় পড়ছেন এখানকার মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
তিনি বলেন, শাহপরীর দ্বীপের এই বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। বোর্ড থেকে বেড়িবাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে উপর মহলে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, জোয়ারের পানির চাপে শাহপরীর দ্বীপের বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এরফলে ওই এলাকার মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য উপর মহলে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫