ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন যে দ্বীপে

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৫
বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন যে দ্বীপে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোনাদিয়া, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: দীর্ঘদেহী মানুষটার সেই ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি তখনও ছিল। প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতার অভ্যেসটাও অনেক পুরনো।

অধিক রাত অবধি নানান গল্পে মশগুল থাকলেও তার ঘুম ভাঙত খুব ভোরে। নির্জন দ্বীপে পছন্দের খাবার তালিকার শীর্ষে ছিল সামুদ্রিক মাছ। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সংগঠিত হয়ে উন্নয়নে অংশ নেওয়ার তাগিদ ছিল তার।

গল্পটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বাঙালির এই অবিস্মরণীয় নেতা এসেছিলেন কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে। এখানে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু যে বাড়িতে ছিলেন, সেই বাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে আশাপাশের এলাকার বয়সী ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে জানা গেল নানান তথ্য।

আলাপে স্থানীয় বাসিন্দারা দুঃখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনাদিয়া দ্বীপে একটি অবকাশ কেন্দ্র হবে। এই দ্বীপ ঘিরে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক নানান কর্মকাণ্ড। অথচ কিছুই হয়নি এখানে। বরং এখানকার মানুষেরা অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্বপাড়ায় প্রয়াত আছত আলীর বাড়ি। এই বাড়িতে চারটি ঘর ছিল। এরমধ্যে একটি ছিল বাংলো। এখানেই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘরের ভেতরে একটি ছোট্ট খাটে ঘুমাতেন বাঙালির এই নেতা। খুব ভোরে ঘুম ভাঙত তার। আছত আলীসহ তৎকালীন মুরব্বিদের সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে আলাপে সময় কাটাতেন অধিক রাত অবধি।

আছত আলীর সেই বাড়িটি এখন নেই। উঠেছে নতুন ঘর। তার ভাইয়েরা আলাদা বাড়ি করেছেন। ছেলে এবং ভাইয়ের ছেলেরাও আলাদা বাড়িতে চলে গেছেন। কিন্তু এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর আগমনের বিষয়টি সবাই জানেন। বয়সী ব্যক্তিরা সবকিছু স্পষ্ট করেই বলতে পারেন। অনেকের কাছে আবার ঘটনাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে।

আছত আলীর ছেলে আবদুল গফুর (নাগু মেম্বার) কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া ওয়ার্ডের মেম্বার। তিনি বলেন, আমরা দেখিনি। গল্প শুনেছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। দ্বীপ নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এই দ্বীপের যথাযথ উন্নয়নের বিষয়ে কোনো সরকারই বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

আছত আলীর মামাতো ভাই কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা গ্রামের বাসিন্দা জোনাব আলী। বয়স ৭৫ বছর। ১৯৭১ সালের আগে বঙ্গবন্ধু যখন এ দ্বীপে আসেন, জোনাব আলী তখন বয়সে কিশোর। আছত আলীর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু খাবার-দাবার এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিলো তার। কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা এই প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, বঙ্গবন্ধু আছত আলীর ঘরের মেঝেতে বিছানো পাটিতে বসে খাবার খেয়েছেন। খাসি, মুরগি আর সমুদ্রের বড় মাছ ছিলো তার খাবারের তালিকায়।

স্মৃতি হাতড়ে জোনাব আলী জানালেন, তখনও বঙ্গবন্ধু সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। হুক্কা টানার অভ্যেসটাও ছিল। আছত আলীর মা সফুরা খাতুন হুক্কা সাজিয়ে দিতেন। আর নানান বিষয়ে গল্পের সঙ্গে গরগর শব্দে হুক্কা টেনে চলতেন জাতির পিতা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আপন করে নিয়েছিলেন সোনাদিয়ার মানুষদের। অত্যন্ত মিশুক স্বভাব ছিল তার।   

জোনাব আলী জানান, আছত আলীর বাড়িতে সবার সঙ্গে ঘনিষ্টতার সূত্র ধরে আছত আলীর মা সফুরা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আছত আলী সাহেব আমার বন্ধু। সে হিসেবে আপনি আমার মা। ’

জোনাব আলী মনে করতে পারেন, তখনকার কিশোর জোনাব আলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হও। দেশের জন্য কাজ কর। দেশকে ভালোবাস। দেশের উন্নয়ন করতে হলে সংগঠিত হতে হবে।

কুতুবজোম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল আমীন প্রয়াত আছত আলীর আত্মীয়। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে এখানে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আরও চারজন। সোনাদিয়ায় অবস্থান করেছিলেন মাত্র দু’দিন। তারপরও এখানকার মানুষদের ভোলেননি তিনি। পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসার পর মহেশখালীর তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে আছত আলীর খোঁজ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ততক্ষণে আছত আলীর আর জীবিত ছিলেন না।

নূরুল আমীন জানান, পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ডেকে পাঠান আছত আলীর পরিবারের সদস্যদের। তখন আছত আলীর ভাতিজা গাজী মেম্বার, জামাত আক্কেল আলী, মেঝ ছেলে বাহাদুর মিয়া, সেজ ছেলে মোস্তফা আলীসহ ৫-৬ জন ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু এদের কাছ থেকে আছত আলীর পরিবার এবং সোনাদিয়ার মানুষের সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। ফেরার পথে যাতায়াত খরচ হিসেবে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে দেন।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সোনাদিয়ায় আসার খবরটি পৌঁছে গিয়েছিলো পাক বাহিনীর কাছে। তাদের কাছে খবর ছিল এই দ্বীপে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছে। এই খবরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান টেকনাফের নাজির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পাকিস্তানিরা এই দ্বীপে হামলা চালায়। এতে চারজনের প্রাণহানি হয়। এরা হলেন আছত আলীর ভাতিজা আবুল কাসেম, জামাতা রহমত আলী, ছোটভাই ছোটমিয়া এবং জুলু মিয়া।

এছাড়াও পাকিস্তানিদের হামলায় আহত হয়ে বেশ কয়েকজন সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পাঞ্জাবিরা কয়েকজনকে ধরে কক্সবাজার সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। তাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরমধ্যেই দেশ স্বাধীন হওয়ায় এই মানুষগুলো প্রাণে বেঁচে যান।

এলাকাবাসী বলেছেন, সোনাদিয়া এখনও অন্ধকারে ঢেকে আছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা জীবন জীবিকার প্রয়োজনে জরুরি অন্য কোনো সেবা এখানে পৌঁছেনি। বঙ্গবন্ধুর দেখে যাওয়া এই দ্বীপের উন্নয়ন চান স্থানীয় বাসিন্দারা।       
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।