সোনাদিয়া (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: একানব্বইয়ের প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়ে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে ‘লেডি অব আইল্যান্ড’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। এই শিরোনামে তার ওপর তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
আর এরই সূত্র ধরে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেলটার নির্মাণে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৬০ কোটি টাকার অনুদান। কিন্তু কোনো কিছু না পেলেও সেই ‘লেডি অব আইল্যান্ড’ এখনও দ্বীপের মানুষের সেবায় নিয়োজিত। বদলায়নি তার ভাগ্য।
নাম তার শোভা রাণী। বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা সদরে। এই বাড়ি কিংবা সন্তানসহ সব স্বজনদের দূরে রেখে পশ্চাৎপদ দ্বীপ সোনাদিয়ার শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তার কাজের সহযোগী স্বামী শচিরাম দাস। তিনিও এখানে শিক্ষকতার চাকরি নেন। ছোট্ট খড়ের ঘরে এই দম্পতির কেটে গেল ২৭টি বছর।
একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন শোভা রাণী। সোনাদিয়া দ্বীপে রেডক্রিসেন্ট ওয়্যালেসের দায়িত্বে ছিলেন স্বামী শচিরাম দাস। বিশেষ প্রয়োজনে এলাকার বাইরে থাকায় এই দায়িত্ব পড়ে শোভা রাণীর ওপর।
ওয়্যারলেস অপারেট কিংবা রেডক্রিসেন্টের অন্যান্য কাজেরও প্রশিক্ষণ ছিল তার। সেগুলোই কাজে লাগালেন। মানুষকে বাড়ি থেকে সাইক্লোন শেলটারে নিয়ে আসাই ছিল তার লক্ষ্য।
সেদিনের গল্পটা বলতে গিয়ে শোভা রাণী বলেন, ছোট মেয়ে দু’টোকে খাটের সঙ্গে বাঁধার পর নিজের কাপড় শক্ত করে কোমরে বেঁধে লোকজনকে শেলটারে তুলি। মানুষ ছিল অসচেতন।
তিনি জানান, তাদের ঘর থেকে বের করা ছিল কঠিন কাজ। তারা ঘর থেকে বের হতে চায়নি। সংকেত আর সাইরেন বাজালেও কেউ আমলে নেয়নি। শেষ মুহূর্তে হঠাৎ পানি বাড়লে সবাই বিপদে পড়ে। মাত্র ১০জন স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় প্রায় সব মানুষকেই সেদিন উদ্ধার করা হয়েছিল।
ওই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের প্রায় সব বাড়ি-ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও একজন লোকও মারা যায়নি। তবে পরেরদিন সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয় সোনাদিয়া দ্বীপে কোনো মানুষ বেঁচে নেই।
এই খবর পেয়ে জার্মান রেডক্রস, জাপান রেডক্রস ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্টের যৌথ টিম আসে এই দ্বীপে। তারা এসে দেখেন এখানকার একজন মানুষও মারা যায়নি। শোভা রাণীর কাছ থেকে তারা শোনেন এখানকার লোকজনকে বাঁচানোর গল্পটা। আর এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তৈরি হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘লেডি অব আইল্যান্ড’।
এই প্রামাণ্যচিত্র সেসময় দেশে-বিদেশে আলোচনা হয়েছে। বিনিময় হয়েছে দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেই ‘লেডি অব লাইল্যান্ডের’ ভাগ্য ফেরেনি।
চাকরির সুবাদে সোনাদিয়া এসেছিলেন শোভা রাণী। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের শিক্ষা প্রসারে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি স্কুল গড়ার উদ্যোগ নেয় ১৯৮৭ সালে।
কিন্তু শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছিল না। একটি সার্কুলার দেওয়া হয়। আগ্রহী হন শোভা রাণী। যথারীতি আবেদন করেন। কিন্তু চাকরি হলে একা কিভাবে এই দ্বীপে থাকবেন।
সেই ভাবনা থেকে তার স্বামী শচিরাম দাসও ওই স্কুলের শিক্ষকের পদে আবেদন করেন। স্কুল পরিচালনার সুবিধার্থে দু’জনেরই চাকরি হয়।
১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষানুরাগী এই দম্পতি সোনাদিয়ায় অবস্থান করছেন। দু’জন মিলে এখানকার ছেলে-মেয়েদের স্কুলমুখী করার উদ্যোগ নেন।
পাশাপাশি রেডক্রিসেন্টের ওয়্যারলেস অপারেটরের দায়িত্বও নেন তারাই। এখানকার মানুষের সংস্কৃতি আর সমস্যা-সংকটের সঙ্গে মিশে যান এই শিক্ষক দম্পতি।
দ্বীপের পূর্বপাড়ায় স্কুলের পাশে একখণ্ড জমিতে একটি খড়ের ঘরে তাদের বাস। শিক্ষকতার সুবাদে এলেও দ্বীপের মানুষের ‘দাদা’ আর ‘দিদি’ হয়ে ওঠেন শচিরাম দাস ও শোভারাণী। দ্বীপের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা গড়ে ওঠে তাদের।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্কুল গড়ার গল্প শোনাতে গিয়ে শচিরাম দাস ও শোভা রাণী জানালেন তাদের বহুমূখী সংগ্রামের কথা।
বলেন, মাত্র ৬০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল এই স্কুলটি। অভিভাবকেরা অসচেতন থাকায় ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আনা ছিল কঠিন কাজ। স্কুলে ভর্তি হলেও প্রথমদিকে ঝরে পড়ার হার ছিল অনেক বেশি। এখনও প্রাথমিক শেষ হওয়ার আগে অনেকে ঝরে পড়ছে। তবে হার কমেছে।
সোনাদিয়া দ্বীপের এই স্কুলে এখন ছাত্রছাত্রী ২২০ জন। প্রধান শিক্ষকের পর থেকে শচিরাম দাস অবসরে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে শোভা রাণী।
তার সঙ্গে সহকারী শিক্ষক হিসাবে আছেন রোকেয়া জান্নাত, মো. শামসুল আলম ও মো. লকিয়ত উল্লাহ। তবে অবসরে গিয়েও শচিরাম দাসের ব্যস্ততা এই স্কুল নিয়েই। শীতের ভোরে সোনাদিয়া দ্বীপে তার ঘরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি স্কুলের পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। এরই ফাঁকে আলাপ হলো নানান বিষয়ে।
দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে শচিরাম আর শোভারাণীর কণ্ঠে আক্ষেপের সুর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কিছুই মেলেনি। এই প্রবীণ শিক্ষক দ্বীপের এই স্কুলে মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন।
পরে ৭০০, ৭৫০; এভাবে ২০১০ সালে এসে বেতন দাঁড়ায় ৫০০০ টাকায়। কিন্তু বেতন বাড়তে না বাড়তেই চাকরির শেষ প্রান্তে চলে আসেন শচিরাম।
অবসরে গিয়ে কল্যাণট্রাস্টের এক লাখ ২০ হাজার টাকার জন্য ঘুরছেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে। আরও কতদিন ঘুরতে হবে জানেন না।
সোনাদিয়ার এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে নানান চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যদিয়ে ১৯৯১ সালে এমপিওভুক্ত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় এটি জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। এখনও বহুমুখী সংকটের মধ্যদিয়ে চলছে স্কুলটি।
শচিরাম দাস বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখাটাই এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্কুলে ক্লাসের পর বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ কম। অভিভাবকদের মাঝে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই।
তার সঙ্গে যোগ করে শোভা রাণী বলেন, কিছু পাওয়ার আশায় আমরা এখানে আসিনি। এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ছেলে-মেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
‘একইসঙ্গে দুর্যোগে এখানকার মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার দায়িত্বটাও আমাদের ওপর পড়ে। এখানকার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সবার সঙ্গে মিলেমিশে আছি, এটাই বড় পাওয়া’—যোগ করেন তিনি।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৫