ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

শিক্ষার্থী ৩৫৭ জন আর শিক্ষক মাত্র একজন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৫
শিক্ষার্থী ৩৫৭ জন আর শিক্ষক মাত্র একজন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুতরিয়া, ধলঘাটা, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: এক ক্লাসে পড়া দিয়ে আরেক ক্লাসে ঢুকতে হয় পড়া নেওয়ার জন্য। দিনে ক্লাস নিয়ে রাতে করতে হয় বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ।

মাত্র একজন শিক্ষক হওয়ায় এভাবেই চালাতে হচ্ছে বিদ্যালয়।

শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনশ ৫৭জন আর শিক্ষক মাত্র একজন। কখনো কখনো পাঠদানে এই শিক্ষককে সহায়তা করছেন আলিম আর স্নাতক (বিএ) শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এলাকার দুই ছাত্রী। এর বাইরে স্কুলের ঘণ্টা বাজানোর জন্য রয়েছেন একজন কর্মী।

এচিত্র কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নের সুতরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

এ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা। যোগাযোগ সমস্যা আর আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে সন্তানকে শহর এলাকার স্কুলেও পাঠাতে পারছেন না তারা। সরকারি বিদ্যালয়ের সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তাদের। তবে সবার আগে শিক্ষক স্বল্পতা দুর করার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান।  
 
সুতরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে চোখে পড়ে সেখানকার চরম দুরাবস্থার চিত্র। একমাত্র শিক্ষক, অভিভাবক, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, সাবেক প্রধান শিক্ষকসহ এলাকাবাসীর কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫৭জন। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৬৪জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে একশ একজন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৭৮জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৬৪জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৫২জন।
২০১০ সালের জুলাইয়ে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন সহকারী শিক্ষক আশরাফুল আলম। বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষক শিরিন আকতার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা করতে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারী শিক্ষক আশরাফুল আলম জানান, একজনের পক্ষে এতগুলো ছাত্রছাত্রী সামলানো অত্যন্ত কঠিন। এক ক্লাসে পড়া দিয়ে আরেক ক্লাসে যেতে হয়। সকালের দিকে ক্লাস শেষ করে আবার বিকেলে স্কুলের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে হয়। কখনো কখনো রাতেও কাজ করতে হচ্ছে।

শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষার মানের ওপর প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করেন আশরাফুল। তিনি জানান, সমাপনী পরীক্ষায় ২০১৩ সালে ‘এ প্লাস’ পেয়েছিল দুইজন, চার পয়েন্ট বা তার বেশি স্কোর ছিল অন্তত ১০জনের। কিন্তু ২০১৪ সালের সমাপনী পরীক্ষায় চার দশমিক ৫০ এর বেশি স্কোর ছিল মাত্র দুইজন শিক্ষার্থীর। ‘এ প্লাস’ পায়নি কেউ।

দেড় কিলোমিটার দূর থেকে বিদ্যালয়ে আসে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সিদরাতুল মুনতাহা সাথী। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠতে তার পরীক্ষার ফলাফল আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। ওই ছাত্রীর মা শামীমা নাসরিন বলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। লেখাপড়া ভালো হচ্ছে না। প্রাইভেট পড়ানোর মত শিক্ষকও এলাকায় পাওয়া যায় না। তাই অবিলম্বে শিক্ষক সংকটের সমাধান করতে হবে।

বিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষক স্বল্পতা ছাড়াও অবকাঠামোগত এবং জমি নিয়ে বিদ্যালয়ের কিছু সমস্যা রয়েছে। যাতে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যালয় এবং দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রটি (সাইক্লোন শেল্টার) সৌদি সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এই ভবনে আটটি কক্ষ রয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ, বাকি তিনটির মধ্যে একটিতে অফিস, একটিতে স্টোর এবং আরেকটি ব্যবহার করছে রেডক্রিসেন্ট।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-২ এর অধীনে বিদ্যালয়ের একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। দুটি কক্ষ বিশিষ্ট এই ভবন ব্যবহার করছে ইউনিয়ন পরিষদ।
অন্যদিকে স্কুল ভবনের সামনে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ভবন। ১৯৭৭ সালে নির্মিত এই ভবন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যেকোন সময় এ ভবন ধ্বসে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অবিলম্বে এ ভবনটি অপসারণের দাবি এলাকাবাসীর।

ওই সূত্র জানায়, বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে রয়েছে আরেকটি সমস্যা। বিদ্যালয়ের মালিকানায় রয়েছে মোট ৩৮ শতক জমি। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান স্কুল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে স্কুলের জমিতে একটি ভবন নির্মাণ করেন। এর নাম দেওয়া হয় পাবলিক লাইব্রেরি। ২০০৫ সালে এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৮ সালে বিদ্যালয়ের পক্ষে মামলার রায় আসে। ওই রায়ে বিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা চারদিনের মধ্যে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। এখনও ওই মামলার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

বিদ্যালয়ের একটিমাত্র নলকূপ দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশের মসজিদ থেকে পানি আনতে হয়। বিদ্যালয়ের টয়লেট ব্যবহারেও রয়েছে নানা সমস্যা। ছাত্রীদের জন্য পৃথক কোনো টয়লেট ব্যবস্থা নেই। রয়েছে অবকাঠামোগত আরও অনেক সমস্যা।

বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. ইউসুফ হারুন বলেন, শিক্ষক সংকট এ বিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক সংকটের সমাধানে আমরা অনেক চেষ্টা করছি। তদবিরও করছি। কিন্তু কোনোভাবেই শিক্ষক সংকট লাঘব হচ্ছে না। শিক্ষক দেওয়ার কথা বলা হলেও দেওয়া হয়নি। এ কারণে অনেক অভিভাবক মনে করছেন ছেলেমেয়েদের অন্য স্কুলে পাঠানো ভালো।

মহেশখালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশীষ চিরান বলেন, ধলঘাটা এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।   

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।