ঢালচর, মনপুরা (ভোলা): নাগরিক সেবার অর্থ বোঝে না এখানকার মানুষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই ভোগান্তি চরমে।
এটা মনপুরার ঢালচরের গল্প। দ্বীপ ভোলার মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি অংশ। বঙ্গোপসাগরের মোহনার এই দ্বীপে ষাটের দশকে বসতি শুরু হলেও সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়। জনশূন্য হয়ে পড়ে গোটা চর। পর্যায়ক্রমে আবার আসতে থাকে লোকজন। কিন্তু নাগরিক সেবার বিন্দুমাত্রও এখানে নেই। দেশের মূলকেন্দ্র, এমনকি জেলা ও উপজেলা সদর থেকেও এ চর একেবারেই বিচ্ছিন্ন।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, ঢালচরে বর্ষায় ঝড়ের আতঙ্ক আর শুকনো মৌসুমে দস্যু আতঙ্ক। ধানকাটা মৌসুমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা চর। বেড়ে যায় দস্যুদের অত্যাচার। ২০১১ ও ২০১২ সালে ব্যাপক দস্যুদের আক্রমণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। ধানকাটা মৌসুমে চরে লোকজনের সংখ্যা বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে ডাকাতির মাত্রা। বছরখানেক আগে এখানে কোস্টগার্ডের কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণের খবরে মানুষের মাঝে স্বস্তি নেমে এলেও এখন আবারও এখানকার মানুষ আতঙ্কিত। কোস্টগার্ডের কেন্দ্রটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে শুধু ঢালচর নয়, আশপাশের অন্তত ১৩ চরের মানুষ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, দুর্গম ঢালচরের বাসিন্দাদের জীবনযাপনে সারা মৌসুমই থাকে চরম অনিশ্চয়তা। বর্ষায় নদীতে ভালো মাছ পড়লে দস্যুদের উৎপাত বেড়ে যায়। অধিক কষ্টে ধরা মাছ লুণ্ঠিত হয়, ধরে নেওয়া হয় জেলেদের। অবশেষে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়। সর্বস্ব হারিয়ে এক একটি জেলে পরিবার পথে বসে। জেলেরা জানালেন, কোস্টগার্ড কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় ঢালচরসহ আশাপাশের দুর্গম এলাকায় বাসিন্দারা স্বপ্ন দেখেছিলেন শান্তিতে বসবাসের। কিন্তু এখন চরের সব মানুষ আতংকে।
চরের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, জলদস্যু ও ভূমিদস্যুদের ভয়ে এখানে জনবসতি গড়ে উঠতে পারেনি। জলদস্যুরা বিভিন্নভাবে এখানকার মানুষদের ওপর অত্যাচার করেছে। দস্যুদের ভয়ে এখানকার বাসিন্দারা বনে গিয়ে আশ্রয় নিতো। চরে বসতি স্থাপন হলে পর্যায়ক্রমে এখানে অন্যান্য কার্যক্রম আসতে পারে।
চরের আরেক বাসিন্দা আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, এখানকার মানুষেরা প্রকৃতি আর দস্যুদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। এখানে মানুষগুলো সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানে বসতি স্থাপনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি মহলের নজর বাড়াতে হবে।
ঢালচরের সরু মাটির রাস্তা আর ধানক্ষেতের আঁল ধরে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বহু মানুষের সঙ্গে দেখা। আলাপ হয় নানান বিষয়ে। শিশুদের কেউ ভেড়ার পালের রাখাল, কেউবা রাজমিস্ত্রির যোগালী, কেউ আবার পানি টানার কাজে খাটুনি দিচ্ছে। শিশুদের কেউ কেউ আবার স্কুলে কী হয়, সেটুকুও বলতে পারলো না।
চরবাসী জসিম উদ্দিনের স্ত্রী খোদেজা বেগম সন্তান প্রসবের সময় মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিলেন। স্থানীয় ধাত্রী মায়া রাণী বলে দিয়েছে মায়ের পেটে বাচ্চা উল্টো অবস্থায় আছে। এখানে প্রসব করানো সম্ভব নয়। একদিকে ঝড়, অন্যদিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদ। রোগীর জন্য পাওয়া যাচ্ছিল না কোনো ডাক্তার। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় রোগীকে শহরে নেওয়ার চেষ্টা। অবশেষে স্পিডবোট ভাড়া করে ভোলা সদরে নেওয়া হয়। পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যায়। খোদেজা বেগম এই যাত্রা বেঁচে যায়।
মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনতে হলেও চরের মানুষকে ছুটতে হয় মনপুরা অথবা পাশের চর কলাতলীতে। চরে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ক্লিনিক, ওষুধের দোকান, এমনকি পল্লী চিকিৎসক কিছুই নেই এখানে। ফলে যুগের পর যুগ এখানকার মানুষের চরম অবহেলার মধ্যে বসবাস করছেন। তবে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কামাল উদ্দিন চৌধুরী ডেমপিয়ার এগ্রিকালচার অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম লিমিটেডের পক্ষ থেকে ৩ একর জমি দেওয়া হয়েছে।
চরবাসী বেলায়েত সরদারের ছেলে ফয়সল (৮) ভেড়া লালন-পালন করে। স্কুলে কেন যেতে হয়, সেটা ওর ভাবনায় আসে না। এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারলো না। জেলে আলমগীর হোসেনের ছেলে জিয়াদ (৭) কোনোদিন স্কুলের গণ্ডি মাড়ানি। ওর অন্য দুই বোনও স্কুলে যায় না। জেলে আবদুল মান্নানের ছেলে হেলাল (৮) কখনোই স্কুলে যায়নি। একইভাবে শহীদুল্লাহর মেয়ে মিনারা (৮), আবুল হোসেনের ছেলে রাজিব (১২) স্কুলের চেহারা দেখেনি, বই হাতে নেয়নি।
অভিভাবকেরা বলেন, এই চরে কোনো স্কুল নেই। এ কারণে বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। সচেতন অভিভাবকদের কেউ কেউ ছেলে মেয়েদের মনপুরা রেখে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেন। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে এটাও অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বাসিন্দারা জানালেন, চরের বাড়িঘর থেকে এখানে ওখানে যেতে কাদাপানি ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ধানক্ষেত্রে আল ধরে লোকজন যাতায়াত করেন। কয়েকবছর আগে এখানে মাত্র দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা নির্মিত হয়। আমেরিকা প্রবাসী ডা. মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী নিজস্ব অর্থায়নে এটি নির্মাণ করে দিয়েছেন। সংস্কারের অভাবে এ রাস্তাটিও মাটির সঙ্গে মিশে যেতে বসেছে।
বহু পুরানো চর হওয়া সত্ত্বেও এখানে রাস্তাঘাট ও বেড়িবাঁধসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। এর ফলে জোয়ারের পানিতে চর প্লাবিত হয়। এতে ফসল নষ্ট হয়, বাড়িঘর পানিতে ডুবে যায়। ঝড়ের দিনে এখানকার মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। আশ্রয়ের কোনো জায়াগা এখানে নেই। মাটির কেল্লা কিংবা সাইক্লোন শেল্টার কিছুই নেই এখানে।
চরবাসী আবদুল হক, মাইনুদ্দিন, আমেনা বিবি, লাইজু বিবি, মনোয়ারা বেগমসহ আরও অনেকে বললেন, সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছি। ছোটখাট ঝড় হলেও এখানকার মানুষের বাঁচার কোনো উপায় নেই। পুরোপুরি নিয়তির ওপর ভর করেই এখানকার মানুষ বেঁচে থাকে। সরকারি-বেসরকারি সেবার কথা এখানকার মানুষদের কেউই বলতে পারেনি।
দুর্গম চরের বিপন্ন জীবনযাত্রার খবর প্রশাসনের কাছে আছে। সরকারিভাবে যথাসম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করা হয়। এমনটাই জানালেন ভোলা জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা। ঢালচরের সার্বিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর প্রশাসনের নজরে আসে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে সব বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
ঢালচর থেকে কোস্টগার্ডের কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (সিসিএমসি) প্রত্যাহার প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, জমি নিয়ে কিছুটা ঝামেলা থাকায় সেন্টারটি অন্যত্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ঢালচরসহ আশাপাশের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৫