চরজগবন্ধু, কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) ঘুরে এসে: ভর দুপুরে মেঘনাপাড়ের বাড়ি থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ। নারী-পুরুষের বুকফাটা আহাজারিতে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা ঘেঁষা উপজেলা কমলনগরের সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগবন্ধু গ্রাম ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। গ্রামের প্রায় ৫০ বছরের পুরনো পলফন বাড়িটি এবার ঝড়ের মৌসুমের আগেই মেঘনা তীর থেকে সরাতে হচ্ছে। বাড়ির প্রধান সাত পরিবারের অনেকেই এরমধ্যে অন্যত্র চলে গেছেন। ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারের দীর্ঘদিনের বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক ঐতিহ্য।
মেঘনার ভাঙন তীরের শূন্য ভিটেয় দাঁড়িয়ে কথা হলো আবু সাঈদ পলফনের সঙ্গে। বয়স ষাট পেরিয়েছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা বড় ছেলে আবুল বাশার পরিজন নিয়ে চলে যাচ্ছেন অনেক দূরে। স্বজন হারানোর শোকে আবু সাঈদের চোখে জল।
চোখ মুছতে মুছতে তিনি জানালেন, অনেকদিন আমরা একসঙ্গে থেকেছি। দুই ছেলে কাছে ছিল। এখন আর একসঙ্গে থাকতে পারছি না। ভাঙন আমাদের শেষ করে দিলো।
আবু সাঈদের বড় ছেলে আবুল বাশার মেঘনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। বাবা-মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে সাজানো পরিবার ছিল। ভাঙণের কারণে বাশার উপজেলার অন্যপ্রান্তে চর কাদিরা ইউনিয়নে একখণ্ড জমি কিনে মাথা গোজার পরিকল্পনা নিয়েছেন। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয়ে দীর্ঘদিনের পেশাটাও হয়তো তাকে ছাড়তে হবে।
পুরানো বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বাশারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, মেয়ে রোকেয়া বেগম, মা হনুফা খাতুন, বাবা আবু সাঈদসহ সিকট স্বজনরা কাঁদছিলেন। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভাঙন তীরের এ বাড়িতে আরও কয়েকবার কান্নার রোল পড়েছে। চলে গেছেন আবুল বাশারের দুই চাচা মো. হানিফ ও মফিজুল হক। বাড়ির বাকি চারটি পরিবারকেও দ্রুত অন্যত্র সরে যেতে হবে। কারণ, মেঘনার ভাঙন পলফন বাড়ির উঠোন ছুঁয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী পলফন বাড়ির বড় ছেলে আবু সাঈদ জানালেন, এক সময় এই বাড়ি থেকে মেঘনা নদীর দূরত্ব ছিল প্রায় দশ কিলোমিটার। নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করেই সাতভাই জীবিকা নির্বাহ করেছি। কখনো ভাবিনি এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। গত বছর বর্ষায়ও ভাঙনের ভয় ছিল না। কিন্তু এবার এবাড়ি ছাড়তে হবে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা সাতভাইকে আলাদা হয়ে যেতে হবে।
কমলনগরের মেঘনাতীরের চর ফলকন, লুধুয়া বাজার, চরজগবন্ধু, কালকিনির মতিরহাটসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সামনের বর্ষা আর ঝড়ের মৌসুম সামনে রেখে বহু মানুষ বাড়ি বদল করছেন। কেউ ঘরের চালা-বেড়া অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা পুরানো গাছপালা কেটে নিয়ে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাড়ির ভিটে, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, স্বজনের কবরস্থান সবই পড়ে থাকছে ভাঙন তীরে।
মেঘনার ভাঙন থেকে খানিক দূরে থাকা বাড়ির মালিকেরা হয়তো আরও একটি বর্ষাকাল এখানে পার করার অপেক্ষা করছেন। তবে তাদেরও রয়েছে ভিন্ন রকমের প্রস্তুতি। কেউ চালা-বেড়া আরেকটু শক্ত করে তৈরি করছেন। ঘরের ক্ষয়ে যাওয়া টিন বদলে ফেলছেন। ভেঙে যাওয়া বেড়াটা মেরামত করছেন। আবার বর্ষায় দ্রুত ভাঙন কাছে এগিয়ে এলে অন্যত্র সরে যাওয়ার বিকল্প প্রস্তুতিটাও রাখছেন।
ভাঙন তীরের বাসিন্দারা জানালেন, প্রতিবছর বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুম এ এলাকার মানুষের কাছে চরম বিপর্যয় হয়ে আসে। এ মৌসুমকে ঘিরেই বেঁচে থাকার সব প্রস্তুতি চলে। বর্ষা এলেই এ অঞ্চলের মানুষের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। যারা কোনোভাবেই নিজের বাড়িতে থাকতে পারছেন না, তারা কেউ শহরে যান, কেউবা অন্যের বাড়িতে ঠাঁই নেন। খুব কম সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ধারদেনা করে এক টুকরো জমি কিনে আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন।
চরফলকনের ঐতিহ্যবাহী লুধুয়া বাজারের কাছে মেঘনাপাড়ে সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক বেলাল হোসেন জুয়েলের সাজানো-গোছানো বাড়িটি গত বর্ষায় ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এবার রক্ষা হবে কিনা অনিশ্চিত। বাড়ির পুকুরের এক প্রান্তে ভাঙনের ছোবল। পুকুরপাড়ের তরতাজা কাঁঠাল গাছ, নারিকেল গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। প্রায় ২৫ বছর বয়সী একটা অর্জুন গাছ আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। বহু নারিকেল ও সুপারি গাছ কেটে পানির দরে বিক্রি করতে হয়েছে। ভাঙন ক্রমেই নানা রঙে সাজানো সেমি পাকা ঘরের দরজার দিকে ছুটছে।
কমলনগর উপজেলার ভাঙন কবলিত ইউনিয়নগুলোর মধ্যে অন্যতম চরফলকন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন বলেন, প্রতিবছর বর্ষা সামনে রেখে ভাঙন তীরের মানুষেরা প্রস্তুতি নেয়। বর্ষা এলে তাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ে। কমলনগর ও রামগতির ভাঙন রোধে বরাদ্দ করা অর্থে কাজ শুরু হলেও কমলনগরের ভাঙনতীরের মানুষের এবারের বর্ষাটা আতঙ্কেই কাটবে। কারণ তীব্র ভাঙন কবলিত এলাকা হিসাবে পরিচিত চরফলকন, পাটারীহাট ও সাহেবেরহাট ইউনিয়নের সীমানায় এখনও ভাঙন রোধের কাজ শুরু হয়নি।
শুধু মেঘনাতীরের কমলনগর আর রামগতি নয়, ভোলার মনপুরার আন্দিরপাড়, রামনেওয়াজ, তজুমদ্দিনের লঞ্চঘাট এলাকা, ভোলা সদরের ইলিশা, চডার মাথা, কাছিয়া, তুলাতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিপন্ন মানুষেরা।
বর্ষপঞ্জির হিসেবে, ১৫ মার্চ থেকে ঝড়ের মৌসুম শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫ অক্টোবর। এ সাত মাস বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি হয় উপকূলের মানুষ। এসময় বহু দ্বীপ ও চর পানিতে ডুবে থাকে। জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয় বাড়িঘর। বহু মানুষ গৃহহারা হয়ে বাঁধের পাশে ঠাঁই নেয়।
গত বর্ষায় ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর ও সৈয়দপুর, মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়া, আন্দিরপাড়, চরফ্যাসনের বেতুয়া, সামরাজ, কুতুবদিয়ার ধুরুং, তাবালরচর, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, খুলনা কয়রা, পটুয়াখালীর রামনাবাদ তীরের লালুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত জোয়ারের পানি ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাজার হাজার একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় বহু মানুষকে।
বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি কমাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে দাবি জলবায়ু স্থানচ্যূত জনগোষ্ঠী নিয়ে কর্মরত এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার।
বেসরকারি সংস্থা ইপসা’র ‘এইচএলপি রাইট ইনিশিয়েটিভ ফর ক্লাইমেট ডিসপ্লেসড পারসন’ প্রকল্পের টিম লিডার মো. শাহজাহান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল প্রচারে সরকার যেভাবে তৎপর, নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা কমাতে সে ধরনের সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দুর্যোগের সিগন্যাল প্রচারের চেয়েও এটা জরুরি। নদীভাঙনে নীরবে বহু মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহতা আমরা সেভাবে চোখে দেখি না।
তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। স্থানান্তরিত প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০২০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৫