ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

যে দ্বীপের শিশুরা স্কুল চেনে না

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৫
যে দ্বীপের শিশুরা স্কুল চেনে না

ঢালচর (মনপুরা, ভোলা) ঘুরে এসে : কারও ইচ্ছা পুলিশের বড় কর্মকর্তা হওয়ার, আবার কারও প্রত্যাশা ডাক্তার হবে। এমন হাজারো স্বপ্ন ওদের মাঝে লুকিয়ে আছে।

কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের কোন সুযোগই নেই ওদের সামনে। কারণ ওরা থাকে উপকূলের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। যেখানে কোন স্কুল নেই। মক্তবে অ-আ-ক-খ শেখার সুযোগটি পর্যন্ত নেই। দ্বীপের ছেলেমেয়েদের অনেকেই জানে না স্কুলে কী হয়।

এটা দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরার ঢালচরের গল্প। এখানে অনেক ভয় নিয়ে রাত গভীর হয়। দিনে রাতে সারাক্ষণই থাকে আতংক। জীবনের প্রতিটি পদে যেখানে বহুমূখী জটিলতা, সেখানে শিশুদের লেখাপড়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না মোটেই। বয়স ৬-৭ বছর পেরোতেই ওদেরকে বেরিয়ে পড়তে হয় কাজে। কর্মজীবন শুরু হয় সেই ছোটবেলা থেকেই। জীবনের খাতা থেকে শিক্ষার অংশটা ঝরে যায় নিজের অজান্তেই।

ঢালচরে সরেজমিন ঘুরে অসংখ্য কর্মজীবী শিশুর দেখা মেলে। অবসর বলতে কিছুই নেই ওদের জীবনে। পানি টানা, মাঠে গরু-মহিষ চড়ানো, নৌকায় মাছ ধরা, ফসলের মাঠে শ্রম দেওয়াসহ অনেক কাজ থাকে ওদের হাতে। আলাপে শিশুরা অনেক স্বপ্নের কথা জানালেও সে স্বপ্ন ওদের নাগালের অনেক দূরে। চারিদিকে নদী বেষ্টিত ঢালচরের এই শিশুদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ আজও গড়ে ওঠেনি। হাইস্কুল তো দূরের কথা, অন্তত লেখাপড়ার সূচনাটা করতে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত নেই। এর ফলে চরের ৬ শতাধিক শিশু বঞ্চিত থাকছে শিক্ষার আলো থেকে।

তেরো বছরের কিশোর হাছানের স্বপ্ন বড় হয়ে র‌্যাবে চাকরি করতে চায়। জলদস্যুদের হাত থেকে চরবাসীকে রক্ষার ইচ্ছা তার। অপরাধীদের শাস্তি দিতে বারো বছরের বাবু স্বপ্ন দেখে পুলিশের বড় অফিসার হওয়ার। আবার তেরো বছরের কিশোরী সুরমা বেগমের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে চরবাসীর সেবা করার। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এইসব শিশুদের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে এর উল্টোটা। আলাপে জানা গেল, ওদের কেউ নদীতে মাছ ধরছে, কেউ মহিষ-গরুর রাখালের কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে সুরমা, আয়শার মত মেয়েরা বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করছে। কখনো যেতে হচ্ছে বাইরের কাজেও।
   
সূত্র বলছে, মনপুরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন ঢালচর ১৯৫৬ সাল সরকারের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করলেও মূলত এর বসবাস শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। পর্যায়ক্রমে চরে নদী ভাঙণের শিকার আশ্রয়হীন মানুষ বসতি গড়ে। চরের খাসজমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন সেখানকার মানুষ। তবে চরবাসীর অন্যান্য সংকটের পাশাপাশি শিক্ষা সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।  

বাসিন্দাদের পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এই চরে তিন হাজার মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ছয় শতাধিক শিশুও রয়েছে। কিন্তু এই শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ফলে হাছান, বাবু, সুরমা, মনি, খাদিজা, পলি, সজিব, ইমাম, রাকিবদের মতো সহ¯্রাধিক শিশুদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে।

ওই চরের বাসিন্দা আবদুল বারেকের ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন থাকলেও সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বড় ছেলেকে সফিককে পার্শবর্তী কলাতলী চরের একটি প্রাইমারী স্কুলে ৩য় শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা শিখিয়েছেন। যোগাযোগ সমস্যা ও দারিদ্রতা বারেকের সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ছেলেমেয়েরা তাকে সাহায্য করে।  

চরের বাসিন্দা রোকসানা বেগম বলেন, একটা ছেলেমেয়েকেও পড়ালেখা করাতে পারিনি। এখানে স্কুল নেই। পাশের চর কলাতলীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে গিয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া করানোর অনেক ইচ্ছা থাকলেও ঢালচরে কোন বিদ্যালয় নেই। এ কারণে ছেলেমেয়েদের কাজে নেমে পড়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।

ঢালচরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। পেশা মাছধরা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, স্কুল-কলেজ নাই। কি করব? ছেলেরা নদীতে মাছ ধরে আর মেয়েরা ঘরে কাজ করে। ছেলেদের অনেকে মহিষের বাথানে কাজ করে। স্কুল থাকলে ওরা পড়ালেখা করতে পারতো। কাজে যেতে হত না।

ঢালচরের মসজিদের ইমাম আবুল কালাম জানান, এই চরে ৫ থেকে ৬ শতাধিক শিশু রয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার অভাবে তাদের লেখাপড়া হচ্ছে না। তারা এগোচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলেও এই চরে স্কুলের সুবিধা গড়ে ওঠেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করে কিভাবে জাতিকে শিক্ষিত করবে সরকার। স্কুল না থাকায় বিদ্যালয় গমনোপযোগী সন্তানদের নিয়ে চরের অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায়।

ঢালচরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও মনপুরা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী জানান, এই চরের শিশুদের শিক্ষার কথা বিবেচনা করে স্কুলের জন্য আমি জায়গা দিয়েছি। একটি ঘরও নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন ও কিছু স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঢালচরের নাম কেটে স্কুলটি অন্য চরে নিয়ে গেছে। চরের শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই চরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান তিনি।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচরের শিশু শিক্ষা প্রসঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সায়েদুজ্জামান জানান, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে গ্রামাঞ্চলে ১৫’শ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করবে। এরই অংশ হিসেবে যে গ্রামগুলোতে লোকবসতি বেশি, কিন্তু  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। সেখানে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।