উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: উপকূলের আতংকের জনপদে দুর্যোগ মৌসুমের প্রথম মাসেই দুর্যোগের ছোবল। কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হেনেছিল পূর্ব-উপকূলে।
উপকূল জুড়ে দুর্যোগের মৌসুম (ডেঞ্জার পিরিয়ড) শুরু হয় ১৫ মার্চ থেকে। অব্যাহত খাতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ে উপকূলের নদনদী উত্তাল থাকে। বেশ কয়েকটি রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে দ্বীপের যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। সতর্কতার পরেও এই মৌসুমে ঘটে যায় অনেক দুর্ঘটনা। এপ্রিলের ১৫ তারিখে দুর্যোগ মৌসুম একমাস পূর্ণ করলো।
দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলের প্রথম কালবৈশাখী আঘাত হানে পূর্ব-উপকূলের নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। পহেলা এপ্রিল কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে নোয়াখালী সদর উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নের পশ্চিম মাইজচরা গ্রামে। বিধ্বস্ত হয় একটি মাদ্রাসা ও নয়টি বসতঘর। এতে শিশু ও নারীসহ আহত হন অন্তত আটজন। ওইদিন সকাল থেকেই উপজেলার সর্বত্র মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করছে। দুপুর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও বাতাস শুরু হয়। বিকেল ৩টার দিকে কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে।
একই দিন নোয়াখালীর সূবর্ণচরের চরজব্বর গ্রামে বজ্রপাতে স্কুলছাত্র নিহত হয়। কিশোরের নাম মো. আব্বাস উদ্দিন। বয়স ৯ বছর। সে কৃষক মো. সামচ্ছুদ্দিনের ছেলে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত উত্তর বাগ্গা সমিতি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আব্বাস স্কুল থেকে আসার পর বাড়ির আঙিনায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু ঘটে।
পহেলা এপ্রিল বজ্রপাতে আরেকজন জেলে প্রাণ হারান লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে। নাম ইমাম হোসেন। বয়স ২৫ বছর। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার বাংলাবাজার রাস্তারমাথা এলাকার নিকটবর্তী মেঘনা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইমাম হোসেন বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের মাদারতোলা গ্রামের মিহির আলীর ছেলে। ঘটনায় আরও দুই জেলে আহত হন।
দুর্যোগ মৌসুমে কালবৈশাখীর প্রথম আঘাতে লক্ষ্মীপুরের শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। কমলনগর উপজেলার ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩টি মসজিদ ও একটি ভূমি অফিসসহ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। বছরের প্রথম দুর্যোগ বহু মানুষকে আশ্রয়হীন করে। অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। দেশের প্রধান সয়াবিন চাষ এলাকা হিসাবে পরিচিত লক্ষ্মীপুরের চাষিদের মাথায় হাত উঠেছে। এবারও ফলনের পুরোটা তারা ঘরে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
মধ্য-উপকূলের মনপুরায় ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে ২ এপ্রিল। দু’দিন মেঘনায় ভেসে থাকার পর নিখোঁজ ২৪ জেলেকে উদ্ধার করা হয়। এই জেলেদের মধ্যে খোরশেদ, জাফর, হামজা, লুৎফর, রিয়াজুল, নাজিম, এরশাদ, রফিক, বাশার, মনির, জাহাঙ্গীর, নেছার, মানিক, আনছার, মাহাবুব, সোহেল, রূপক, নুর মোহাম্দ, মোবারক, বারেক, আজিজ ও রুবেল নামের জেলেরা ছিলেন। কুতুবদিয়া মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের দিদারুল্লাহ দিদারের ‘এফবি আল্লাহ-মালিক’ নামের ট্রলারটি নিয়ে পহেলা এপ্রিল দুপুরে জেলেরা মাছ শিকারে যাত্রা করেন। এরপর যেকোন সময় এটি ঝড়ের কবলে পড়ে।
৩ এপ্রিল পূর্ব-উপকূলে খাদ্যশস্য বোঝাই লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে দুইটি জাহাজের সংঘর্ষে এ ঘটনা ঘটে। তবে দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যান জাহাজটির নাবিকরা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খাদ্যশস্য বোঝাই করে সন্দ্বীপের দিকে যাচ্ছিলো এমভি মারসাদ-২ নামের লাইটারেজ জাহাজটি। পথিমধ্যে চ্যানেলের সাউথ ইস্ট বয়ার কাছাকাছি এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা এমভি সালমা নামের আরেকটি লাইটারেজ জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। জাহাজটিতে একহাজার ৫০ টন খাদ্যশস্য ছিল।
দুর্যোগ মৌসুমের প্রথম মাসেই ছিল পূর্ণিমা পরবর্তী জোয়ারের প্রবল চাপ। ৪ ও ৫ এপ্রিল জোয়ারে লবণ পানি প্রবল বেগে ঢুকে পড়ে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নে। পাঁচ গ্রামের চাষির বোনা আউশ আবাদ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ডুবে গেছে রবিশস্যের ক্ষেত। ফলে কৃষকের অন্তত এক হাজার একর জমির ফসল হানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। লালুয়ার চারিপাড়া, পশুরবুনিয়া, চৌধুরিপাড়া, নয়াকাটা, মহিপুরের নিজামপুর, চাকামইয়ার কাঠালপাড়ায় কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কবলে পড়েছেন। বাড়ির উঠোনের সবজি পর্যন্ত লোনা পানিতে ডুবতে বসেছে বহু কৃষকের।
স্থানীয় সূত্র বলেছে, বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় পর পর দু’টি বছর লালুয়ার রামনাবাদ নদী পাড়ের প্রায় দেড় হাজার কৃষক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এবছর আমন ফসল পায়নি। শুকনো মৌসুমে বোনা আউশ আবাদের প্রস্তুতি নেয় এরা। কিন্তু পূর্ণিমা পরবর্তী তিন দিনে তাদের সব লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রতি দিন জোয়ারে দুই দফা পানি প্রবেশ করছে জনপদে। উঠোনের সবজি পর্যন্ত রক্ষা হচ্ছে না। পুকুর-খালে লোনা পানি প্রবেশ করেছে।
কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, লালুয়ার পাঁচটি গ্রামের অন্তত ১০০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে গ্রামের ভেতর লোনা পানি প্রবেশ করায় গ্রামের সকল জমি আউশ আবদ করার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে।
ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামার তারা জানান, চারিপাড়া ও পশুরবুনিয়া গ্রামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে গত বছর বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে কৃষকরা আউশ আবাদ করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সক্ষম হতো। এখন কৃষকদের জমি থাকলেও ফসল ফলানোর কোন সুযোগ নেই।
উপকূলের দুর্যোগ কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিবছর ঝড়ের মৌসুমে গোটা অঞ্চল জুড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হলেও নিরাপত্তায় বিশেষ কোন প্রস্তুতি নেই। দুর্যোগের কবলে পড়ে বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। ঝুঁকি নিয়ে ভয়াল নদীপথ অতিক্রম করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে নাগরিকদের মাঝেও নেই সচেতনতা।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০১২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৫
জেডএম/