ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

অরক্ষিত উপকূল-১

আতঙ্ক তাড়িয়ে ফেরে সারা বছর

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৯ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৫
আতঙ্ক তাড়িয়ে ফেরে সারা বছর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।

আশ্রয়হীনেরা ছুটে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাপ-দাদার পুরোনো ভিটে ছেড়ে দিয়ে মাথা গোঁজে বাঁধের ধারে। কারও ঠিকানা মেলে শহরের রাস্তার ধারে। কখনো জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, কখনোবা অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যায়। বর্ষায় ভাঙণের চিত্রটা এখন একেবারেই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। ঝুঁকি বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত। এইসব নিয়ে ‘অরক্ষিত উপকূল’ শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।

উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: বাঁশের বেড়া আর বালুর বস্তা ফেলে কোথাও বেড়িবাঁধ রক্ষার চেষ্টা চলছে। আবার কোথাও যথাযথ কাজ না হওয়ায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ সাইক্লোন শেলটার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বহু গ্রাম থেকে সাইক্লোন শেলটার অনেক দূরে। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জন্য একটা শেলটার নির্মাণ করা হলেও সেখানে পৌঁছানোর মত রাস্তা হয়নি। আবার অনেক স্থানে নেই সবুজ-বেষ্টনীর নিরাপত্তা।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, কাঠগড়, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া ঘুরে মিলেছে মানুষের সংকটের চিত্র। এইসব এলাকায় প্রলয় এসেছিল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। ভাসিয়ে নিয়েছিল সবকিছু। এরপর পার হয়েছে দুই যুগ। তবুও ভয় কাটেনি। নির্বিঘ্ন হয়নি এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। গোটা অঞ্চল এখনও অরক্ষিত।

এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৮০ কিলোমিটার উপকূল অরক্ষিত। দীর্ঘ উপকূলের এই ১৮০ কিলোমিটারেই বনায়ন নেই। এছাড়া, উপকূলীয় বেড়িবাঁধও মজবুত নয়। ফলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র বলছে, ১৯৬৫ সালেই পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে ১৯৯৩ থেকে ৯৬ সালের মধ্যে ৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে নতুন করে বেড়িবাধঁটি নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি এলাকায় এক কিলোমিটার সি-ওয়াল, পতেঙ্গা থেকে হোসেন আহমদ পাড়া পর্যন্ত পাথরের ব্লক, সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২৩ কিলোমিটারের মধ্যে ২৩টি স্লুইজগেটের প্রায় সবগুলোই এখন অকেজো।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাউবো বালুর ভর্তি বস্তা ফেলে, বাশেঁর খুঁটি-বেড়া দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করছে এই বাঁধ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কয়েক স্থানে একেবারে ভেঙে গেছে। আবার পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে স্টিল মিল এলাকার হোসেন আহমদ পাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে পাথরের ব্লক দেওয়া হলেও অনেক স্থানে এসব পাথরের ব্লকও তছনছ হয়ে গেছে।

উত্তর পতেঙ্গা পশ্চিম হোসেন আহমদ পাড়ার বাসিন্দা মো. সোলায়মান বাংলানিউজকে বলেন, নির্মাণের পর প্রায় দীর্ঘ ২০ বছরে উল্লেখযোগ্য সংস্কার না হওয়ায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাউবো নির্মিত বাঁধটি বিপন্ন হয়ে পড়ায় নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলে পানিতে তলিয়ে যাবে বন্দর নগরী। তাছাড়া, এই বাঁধের মানুষদের দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়ার মত নিরাপদ কোনো স্থান নেই।

শহর রক্ষা বাধঁটি বিপন্ন হয়ে পড়ায় পুরো এলাকার মানুষের দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। নিম্নচাপ কিংবা অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় সাগরে পানি বেড়ে গিয়ে তীরে ঢেউ আঁছড়ে পড়লে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে এখানকার মানুষদের। বাঁধের বাইরে থাকা বাসিন্দাদের জীবন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে জোয়ারের পানি ঠেকাতে ঘরের চারপাশে মাটি ফেলে উঁচু করে নিয়েছে।

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্তের মানুষেরা দুর্যোগ মৌসুমে ঝুঁকির মুখে থাকে। পশ্চিমে রহমতপুর ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রহমতপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, রহমতপুর স্লুইজগেট থেকে আজমপুরের সীমানা পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আট মাস আগে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। স্থানীয় উদ্যোগে কিছু বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। জলবায়ু ট্রাস্টফান্ডের আওতায় সন্দ্বীপের কিছু এলাকায় বাঁধের কাজ হলেও এই এলাকায় কোনো কাজ হচ্ছে না।

সন্দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তে সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার বহু মানুষ ঝুঁকিতে থাকে সারা মৌসুম। এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, সব হারানো বহু পরিবার এখনও ভাঙন কবলিত এলাকার আশপাশেই বসবাস করছেন। তাদের বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারও কোনো জায়গা নেই। বাংলাবাজারের ঐতিহ্যবাহী মৎস্য বাজারটি বিলীন হওয়ার পথে। এইসব এলাকার বাঁধের পাশের গাছপালাও বিলীন হয়ে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য মতে, উপকূলীয় বনায়ন না থাকায় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়েছিল। তাদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে মুসলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ রয়েছে। পরবর্তী আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কোনো বনায়ন নেই। হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় কিছু বনায়ন থাকার পর কাট্টলী এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বনায়ন রয়েছে। আর বাকি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় সবুজ-বেষ্টনীর চিহ্ন মাত্র নেই।

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ছিল ‘চকরিয়া সুন্দরবন’। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এই বনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন এলাকার মানুষ। বদরখালী বাজারে আলাপকালে অনেকেই বলছিলেন ওই বনটি থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকার এতো ক্ষতি হত না।   

উপকূলের মানুষ দুর্যোগ থেকে বাঁচার নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে দাবি তুলছে। সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা, চকরিয়া, কুতুবদিয়া এলাকার ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত মানুষদের কাছে এখনও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দাবিটাই প্রধান হয়ে আছে। তারা বলেন, ‘যা হারিয়েছি তা কেউ ফেরত দিতে পারবে না। বাকি জীবনটা বেঁচে থাকার নিরাপত্তা চাই। শুধু ঘূর্ণিঝড়ের আগে-পরে নয়, সারাবছরই সরকারের সুনজর চাই। ’

দুর্যোগে সব হারানোর কথা মনে করে চোখ ভিজে ওঠে উপকূলের মানুষের। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী হাজী নূর মোহাম্মদ বলছিলেন, তাদের যৌথ পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৬। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরমধ্যে তার বাবা-মা ও পাঁচ ছেলেমেয়ে ছিলেন। শুধু বাবা ও এক ছেলের লাশ পেয়েছিলেন। বাকিদের কোনো সন্ধান মেলেনি। বদরখালীর এই এলাকায় মাত্র পাঁচ শতাংশ বাড়ি অবশিষ্ট ছিল, বাকিগুলো উড়ে যায়।

বদরখালী বাজার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ফিশারী ঘাটে চায়ের দোকানে আলাপকালে সেইদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন অনেকেই। মোজাফফর আহমেদ, নাসির উদ্দিন, মো. হাশেম, আলী হোসেনসহ উপস্থিত প্রায় সকলেই ওই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখেছেন। এখন আর তারা সেদিনের কথা মনে করতে চান না।

ভয়াল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কথা মনে পড়লে এখনও ভয়ে শিউরে ওঠেন চট্টগ্রাম সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার মানুষ। বিপর্যয়ের পরের বছর চট্টগ্রাম শহর রক্ষায় উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু এখন সে বাঁধ আবারও ঝুঁকিতে। অরক্ষিত উপকূল অঞ্চল রক্ষার দাবিটাই এখন তাদের কাছে প্রধান।
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ; উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২৫৬ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৫
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।