ঢাকা, বুধবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

আইলা’র ৬ বছর, স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাত্রা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৪ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫
আইলা’র ৬ বছর, স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাত্রা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আইলা বিপন্ন জনপদ ঘুরে: বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট আরও বেড়েছে। দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট।

মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবাদি পশুর খাবার নেই। কমেছে কাজের সুযোগ। খাদ্য নিরাপত্তা পড়ছে বাঁধার মুখে। আর এ সব কিছুর ওপর বেড়িবাঁধের অবস্থা এখনও নড়বড়ে, নাজুক। নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেলটার।  

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা বিধ্বস্ত জনপদের অবস্থা এমনই। খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, মংলাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব তথ্য মিলেছে। এলাকাবাসী বলেছেন, আইলা’র পরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও সাধারণ মানুষ তার প্রকৃত সুফল পায়নি। বহু মানুষ দেনা-দায়ে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
 
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা’র প্রলয় কোনো মতে টিকে থাকা মানুষদের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা আঘাত হানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। সেই হিসেবে সোমবার আইলা প্রলয়ের ৬ বছর পূর্ণ হয়।

আইলার আঘাতে উপকূলীয় ১১ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলা শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা। আইলার ফলে এই চার উপজেলার প্রায় ১৩টি ইউনিয়ন নোনা পানিতে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে যায়। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, মহেশ্বরীপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়ন, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন, দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন।

কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ঘড়িলাল বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলী আহম্মদ বলেন, আইলা এই এলাকার মানুষদের শেষ করে দিয়েছে। বহু মানুষ সহায়-সম্পদ হারিয়ে পথে বসেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়ানোর মত সহায়তা পায়নি। যেসব সহায়তা এসেছে তার অধিকাংশই জরুরি খাদ্য হিসেবে এসেছে।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ঘড়িলাল, গোলখালী, আংটিহারা, জোড়শিং, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের পারশেমারী এবং আশাপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবুজের চিহ্ন নেই। লবণের কারণে জমিতে কোনো ফসল হচ্ছে না। এমনকি রাস্তার আশপাশে গাছপালাও হচ্ছে না। এলাকায় জ্বালানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বহু পুরনো গাছপালা মরে গেছে। নতুন করে কাঠ কিংবা ফলের গাছ লাগানো হলেও তা ভালো হচ্ছে না।

পারশেমারী গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম হাওলাদার বলেন, ৬ বছর আগে আইলা আঘাত হানলেও এখন পর্যন্ত এই এলাকার মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এই দিনটি এলে স্বজনহারা মানুষের কান্নার শব্দে সুন্দরবন লাগোয়া এসব গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এলাকা পুরোপুরি সবুজশূন্য হয়ে পড়ায় কাজ ও খাদ্যের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ঘড়িলাল বাজারে জড়ো হওয়া লোকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, আইলা এই এলাকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে দিয়েছে। সিদ্ধ চালের বদলে অনেকে এখন আতপ চালের ভাত খান। কারণ একদিকে আতপ চাল দামে সস্তা, অন্যদিকে অল্প জ্বালানিতে এ চাল সিদ্ধ হয়। এছাড়া বাড়ির আঙিনায় ফলানো সবজি খাওয়ার প্রচলন একেবারেই উঠে গেছে। হাতে গোনা দু’চার বাড়িতে সবজির ক্ষেত দেখা যায়।

সরেজমিন ঘুরে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, আইলা বিধ্বস্ত জনপদে আগেই খাবার পানির তীব্র অভাব ছিল। বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় সব মিঠা পানির উৎস লবণাক্ত পানিতে ভরে যায়। লবণাক্ত পানি ঢুকে বহু গভীর নলকূপ অচল হয়ে যায়। পানি সংকট নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে এলাকার সব মানুষের কাছে বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। শুকনো মৌসুমে এইসব এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। পানি সংকটের সঙ্গে খাদ্যাভাব এলাকার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

কয়রার পাথরখালি এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, আইলা দুর্গত এই এলাকায় বরাবরই পানীয় জলের সংকট থাকলেও আইলার পর থেকে তা প্রকট আকার ধারণ করে। যা এখনও পর্যন্ত অব্যহত রয়েছে। শুধু পনিই নয়, খাদ্যাভাবেও এই অঞ্চলের মানুষ ভুগছে চরম পুষ্টিহীনতায়। এলাকার মানুষের কাছে এক কেজি চালের চেয়েও এক গ্লাস পানির গুরুত্ব অনেক বেশি।

আইলা বিপন্ন জনপদ ঘুরে জানা গেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জেলে, চাষি থেকে শুরু করে সব ধরণের পেশাজীবীর ওপর আইলার প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষের কাজের ধরণ বদলে গেছে। হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহকারী চাষি সব হারিয়ে মাছধরা পেশায় নেমেছে, কিংবা কাজের সন্ধানে শহরে ছুটেছে। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মানুষের হাতে টাকা পয়সা না থাকায় বেচাকেনা কম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন কেনাকাটা করে না। কিনলেও বাকির খাতা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অতি সহজেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে। তবে দাকোপ, কয়রা ও শ্যামনগর উপজেলার বহু মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে অস্বাভাবিক অবস্থায় জীবনযাপন করেছেন। এদের একটি অংশ এখনও কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে। তিন বেলা ঠিকমতো খাবার যোগাড় করতে না পারায় এরইমধ্যে এই অঞ্চলের অন্তত এক লাখ মানুষ স্থানচ্যুত হয়ে অভিবাসনে বাধ্য হয়েছে। এদের মধ্যে আবার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ খুলনা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সুপার সাইক্লোন সিডর উপকূলীয় এলাকার জীবন, জীবিকা, প্রতিবেশ, কৃষি, অর্থনীতি, সামাজিক ও প্রাকৃতিক সুরক্ষাকে বিপর্যয়ের কিনারে ঠেলে দিয়েছিলো। আর আইলা এসে তাদের বিপন্নতার খাদে ছুঁড়ে ফেলেছে; যেখান থেকে এখনও মানুষ উঠে আসতে পারেনি।

সূত্র বলছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও চরম অব্যবস্থাপনায় ষাটের দশকে নির্মাণ করা বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ কারণে ২০০৭ সালের পর ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা’র ধাক্কায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়। বিপন্ন হয় বহু মানুষের জীবন।

আইলা’র আঘাতে ৭৬ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং ৩৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো, আইলায় তিন লাখ ২৩ হাজার চারশ’ ৫৪ একর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার মধ্যে দাকোপ, কয়রা ও শ্যামনগর উপজেলার প্রায় এক লাখ একর জমি প্রায় দেড় বছর জোয়ারের পানিতে ডুবেছিল। এ কারণে সহায় সম্বল হারিয়ে এলাকার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলো বেড়িবাঁধের উপর। এখনও বহু মানুষ সেই বেড়িবাঁধ ছাড়তে পারেনি।

সরকারি হিসাবে, ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৩০ জন। এছাড়া আইলার আঘাতে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো সাত হাজার একশ’ তিন জন মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় লাখ ১৩ হাজার সাতশ’ ৭৪টিতে। আইলা’য় নয় লাখ ৪৮ হাজার ছয়শ’ ২১টি পরিবার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৯ লাখ ২৮ হাজার দু’শত ৩০ জন।

বছর ঘুরে আসে আইলা’র সেই প্রলয়ের দিন। এদিন এলে স্বজনহারানো মানুষেরা প্রিয়জনের স্মৃতি নিয়ে কাঁদেন। তবে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হওয়া জনপদের মানুষেরা সারাবছরই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ বহুমুখী সংকটে ভোগেন। এর প্রতিকার কবে হবে, তা জানেন না তারা।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২২৮ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫
আরআইএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।