কলাপাড়া, পটুয়াখালী: বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই দুশ্চিন্তায় অস্থির সমুদ্র মোহনা রামনাবাদ তীরের কয়েক গ্রামের মানুষ।
বর্ষার শুরুতে বাড়িঘরে ও ফসলের মাঠে জোয়ারের পানি প্রবেশ মানেই তাদের কাছে এক অশনি সংকেত।
সামনে মাসখানেকের মধ্যে নদীর পানি আরো বাড়লে তখন অবস্থা হবে আরো শোচনীয়। এসব গ্রামজুড়ে এখন সে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চিত্রটা সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের। রামনাবাদ নদীর তীরে এই ইউনিয়নের চারিপাড়াসহ আশাপাশের গ্রামগুলো বিরান পড়ে আছে। ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর, ফসলের মাঠে পানি থই থই করছে। চলাচলের জন্য কোথাও কোথাও ব্যবহার করতে হয় নৌকা।
লালুয়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র বানাতী বাজার থেকে চারিপাড়া গ্রামের প্রবেশ পথের ভাঙাচোরা রাস্তা আর ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো জানান দিল এ এলাকার বর্তমান অবস্থা।
যতোই গ্রামের ভেতরের দিকে প্রবেশ ততোই যেন দুর্গম থেকে দুর্গমে যাত্রা। মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তাতেই নড়বড়ে সাঁকো পেরোতে হয় চার-চারটি। এই পথেই গ্রামের মানুষের যাতায়াত, হাটবাজার করা, মালামাল পরিবহন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া, সব কিছু।
চারিপাড়া গ্রাম থেকে বানাতী বাজারে যাওয়ার পথে দেখা মিললো গ্রামবাসী ফিরোজ উদ্দিনের। তিনি বললেন, কেবল বর্ষা শুরু হয়েছে। নদীর পানি কিছুটা বাড়তেই ফসলি মাঠ ডুবে গেছে। বাড়িঘরেও ঢুকেছে পানি। গত বর্ষায় তো এই এলাকার মানুষ ডুবেই ছিল। এবারের বর্ষায় যে কী অবস্থা হবে, জানিনা।
তার কথা বলার সময় আশপাশে জড়ো হয় আরো কয়েকজন। তারা মনে করিয়ে দিলেন, গত বছরের প্লাবনের কথা। তারা জানান, গত বছর বাঁধভাঙা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল বাড়িঘর, ফসলি মাঠ। ডুবে গিয়েছিল রাস্তাঘাট।
সেবার কারো পুকুরে মাছ ছিল না। এলাকার মানুষ জমিতে আবাদ করতে পারেনি। চলাচলে যোগ্য এক চিলতে পথও অবশিষ্ট ছিল না। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। জীবিকার খোঁজে ছুটেছে শহরে। গত বর্ষার সংকট কাটিয়ে না উঠতেই এবারো বর্ষা নিয়ে একই দুশ্চিন্তা।
উপকূলের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের ছয় গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এমন হাজারো সংকটের মধ্যে বেঁচে আছেন।
ইউনিয়নের রামনাবাদ লাগোয়া প্রান্তিক এই জনপদের অবস্থাপন্ন মানুষেরাও এখন পথে বসেছেন। এককালে সবুজে ভরে ওঠা গ্রাম এখন বিরান পড়ে আছে। একসময়ের বছরে ২-৩ ফসলি উর্বরা জমি ফসলহীন পড়ে আছে বছরের পর বছর। বার বার আবাদের চেষ্টার পরও ব্যর্থ হয়ে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য পেশায় জীবিকার পথ খুঁজছেন চাষিরা।
বহু বছর ধরে সবুজে ভরে থাকা এই জনপদের বিপন্ন অবস্থার প্রধান কারণ রামনাবাদ তীরের বাঁধ বার বার ভেঙে যাওয়া। প্রসঙ্গ তুলতেই সবার আঙুল বিধ্বস্ত বাঁধের দিকে। গ্রামবাসীর কণ্ঠে অভিযোগের সুর। বিপন্ন এ বাসিন্দারা জানান, টাকা বরাদ্দ হয়, কাজও হয়; কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। নদী থেকে লবণ পানি প্রবেশ বন্ধ হয় না, মানুষের দুর্ভোগও কমে না।
রামনাবাদ নদীর তীরে বিধ্বস্ত বাঁধের তীরে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পঁয়ষট্টি বছর বয়সী মোসলেম আলী শিকদার জানালেন, এই বয়সে নদীর তীরে পাঁচবার বাঁধ তৈরি করতে দেখেছেন তিনি। প্রথমবার মোটামুটি শক্ত ও উঁচু বাঁধ হলেও পরের বাঁধগুলো টেকসই হয়নি। আর সে কারণেই প্রথমবার তৈরি করা বাঁধের চিহ্ন এখনও রয়েছে গেছে আর পরের বাঁধগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই এলাকাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে শক্ত একটা বাঁধের দাবি তার।
এতটা বিধ্বস্ত-বিপন্নতার মধ্যে ছবি তোলা আর তথ্য সংগ্রহে বিরক্ত গ্রামবাসী আমজাদ হাওলাদার অনেকটা ক্ষোভের সুরেই বলেন, সরকার বরাদ্দ দেয়। কিন্তু পথে পথে সব শেষ হয়ে যায়। আমরা কিছুই পাই না। বরাদ্দের অর্ধেকও মাঠে খরচ হয় না। ঠিকঠাক কাজ হলে সমস্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে। আমাদের এত দুর্ভোগে থাকতে হবে না।
চারিপাড়াসহ বিপন্ন ছয় গ্রামের অবস্থা বোঝার জন্য কারো সঙ্গে কথা না বললেও চলে। শুধু গ্রামের পথ ধরে হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে এর বিপন্ন চেহারা। রাস্তার ওপরে ছোট্ট কালভার্ট পরিণত হয়েছে বড় খালে। পথ চলার জন্য গ্রামবাসীর উদ্যোগে সেখানে দেওয়া হয়েছে বাঁশের সাঁকো। এমন সাঁকো রয়েছে চারটি।
আরও কয়েকটি সাঁকো ছিল; সেগুলো গ্রামবাসী সংস্কার করেছে। এসব সাঁকো দিয়েই এখন গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুরা যাতায়াত করে। রাস্তার দু’ধারে শত শত একর ফসলি জমি বিরান। কোথাও জমে আছে পানি। অন্যসব এলাকা থেকে এই এলাকাটি যেন একেবারেই আলাদা।
গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, বহুদিন ধরে সাজানো বাড়িগুলো একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকা অনেক ঘর মাটির সঙ্গেই মিশে গেছে। হাঁস-মুরগির খামার, গবাদি পশুর ঘর, সবজির ক্ষেত, পুকুরের মাছ কিছুই নেই। রাস্তার পাশের ঘর থেকে রাস্তায় উঠতেও অনেক বাড়ির সঙ্গে দেওয়া হয়েছে সাঁকো। প্রত্যেক বাড়িতেই ধ্বংসস্তুপের ছাপ স্পষ্ট। বসতবাড়ির ভিটে থেকে মাটি সরে গেছে। গাছপালা মরে গেছে। বাড়ির আঙিনা থেকে বাড়তি উপার্জনের পথটুকুও বন্ধ হয়ে গেছে।
হিসেব দেখালেন লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মজিবর রহমান। তিনি জানালেন, ইউনিয়নের চার ও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ছয়টি গ্রামের অবস্থা শোচনীয়। গ্রামগুলো হচ্ছে : চারিপাড়া, বানাতী, এগারো নম্বর হাওলা, ধনজুপাড়া, চৌধুরীপাড়া ও নয়াকাটা। এইসব গ্রামের ৯০০ পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।
তিনি বলেন, রামনাবাদের তীরে সাড়ে কিলোমিটারে বেড়িবাঁধ নেই। ২০১০ সাল থেকে এই অবস্থা। বেশ কয়েকবার মেরামত করা হলেও তা টেকসই হচ্ছে না। নদীর প্রবাহ রোধ না করে বাঁধ দেওয়া হলে তা টেকসই হবে না। নদী ভরাট হয়ে পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। জোয়ারের পানি উপচে ফসলি মাঠ ও বাড়িঘর ডুবিয়ে দিচ্ছে। এক সময় এই এলাকায় ধানসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল হলেও এখন তা চাষিদের কাছে স্বপ্ন।
লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, বাঁধ না থাকায় রামনাবাদ নদী থেকে লবণ পানি প্রবেশ করছে। এর ফলে ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৫১৫ একর জমিতে কোন ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। বহু নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত বর্ষায় ইউনিয়নের ৪ হাজার ৩৯৬টি পরিবারের মধ্যে ১৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ কোনো সহায়তা আসেনি।
এদিকে, নদীতীরের এই ইউনিয়নের ছোট পাঁচনং, বড় পাঁচনং, নাওয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া ধঞ্জুপাড়া, এগারোনং হাওলা, পশরবুনিয়া, হাচনাপাড়া ও মুন্সিপাড়া গ্রামে কোনো সাইক্লোন শেলটার নেই। ফলে এই এলাকার মানুষ প্রায় সারা মৌসুম দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকেন। এইসব এলাকায় অন্তত চারটি সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের প্রস্তাব করেছে ইউনিয়ন পরিষদ।
পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, অবিলম্বে এই বিপন্ন এলাকার মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। ঘরহারা মানুষদের পুনর্বাসনে আবাসন প্রকল্প করতে হবে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সড়ক পুনঃনির্মাণ করতে হবে।
এসব প্রস্তাব লিখিত আকারে ঊর্ধ্বতন মহলে পাঠানো হলেও তেমন সাড়া নেই বলেও অভিযোগ এ জনপ্রতিনিধির।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০১৪২ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫
আরআইএম/এসআর